বাংলাদেশ কাথলিক মণ্ডলীতে অনুষ্ঠিত হল সিনড এবং সিনোডালিটি বিষয়ক সেমিনার
গত ২৭ থেকে ২৯ জুন ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর অয়োজনে আসাদগেট (সিবিসিবি) সেন্টারে অনুষ্ঠিত হল তিনদিন ব্যাপি সিনড এবং সিনোডালিটি বিষয়ক সেমিনার।
উক্ত সেমিনারের মূলসুর ছিলো “বাংলাদেশ মণ্ডলীতে সিনড এবং সিনোডালিটি”। এই সেমিনার পরিচালনা করেন ভাটিকানের সিনড বিষয়ক আণ্ডার সেক্রেটারী (অধীন সচিব) সিস্টার নাতালি বেককুয়ারর্ট এক্স,এম,সি,জে এবং এফএবিসির সামাজিক যোগাযোগ কমিশনের নির্বাহী সেক্রেটারী ফাদার জর্জ প্লাথোটাম, এসডিবি।
প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের আর্চবিশপ বিজয এন. ডি’ ক্রুজ। সেই সাথে আরো উপস্থিত ছিলেন কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’ রোজারিও, বিশপ জের্ভাস রোজারিও, বিশপ পল পনেন কুবি, বিশপ জেমস রমেন বৈরাগী, বিশপ সেবাস্টিয়ান টুডু সহ বিভিন্ন ধর্মপ্রদেশ থেকে আগত ফাদার, ব্রাদার, সিস্টার এবং খ্রিস্টভক্তগণ মিলে প্রায় ৮০ জন অংশগ্রহণকারী অংশগ্রহণ করেন।
এই সেমিনারের মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ছিল, “সিনড এবং সিনোডালিটি” সম্পর্কে মন্ডলীর সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রকাশ করা।
বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর সেক্রেটারী বিশপ পল পনেন কুবি তার শুভেচ্ছা বক্তব্যে বলেন, “ খ্রিস্টমণ্ডলীতে বিগত কয়েক বছর ধরে আলোচিত একটি বিষয় হলো ‘সিনড ও সিনোডাল মণ্ডলী’। তবে মণ্ডলীতে তা নতুন কোন ধারণা নয়। এম্মাউসের পথে যিশু নিজেই শিষ্যদের সাথে একত্রে পথচলার মধ্য দিয়ে সিনডের রূপ প্রকাশ করেছেন।”
এই সেমিনারের শুরুতেই পবিত্র খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’ রোজারিও। তিনি তার উপদেশ বাণীতে বলেন, “পোপ ফ্রান্সিস প্রবক্তার মতো সিনোডাল মন্ডলীর আহ্বান জানিয়েছেন যেন আমরা নতুন ভাবে দেখি। অন্যদের কথা আমরা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করি। কিন্তু সময়ের প্ররিক্রমায় মন্ডলীর মধ্যে জাগতিক অনেক চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ প্রবেশ করেছে যা অন্যদের কথা শ্রবণ করার পরিবর্তে নিজস্ব গন্ডির মধ্যে আমাদের আকৃষ্ট করে ফেলেছে। সেই নির্বাসন থেকে আমাদের মুক্তি পেতে পোপ আমাদের আহ্বান জানান এই সিনোডাল প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে আমরা সবাই যেন একসাথে পথ চলি।”
এফএবিসির সামাজিক যোগাযোগ কমিশনের নির্বাহী সেক্রেটারী ফাদার জর্জ প্লাথোটাম, এসডিবি তার বক্তব্যে বলেন, “পুন্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস আমাদের একান্তভাবে আহব্বান করেন যেন এই সিনোডাল মন্ডলীর প্রক্রিয়া করণের জন্য আমরা পবিত্র আত্নার কন্ঠস্বর শুনি যেন এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বের সকলের মধ্যে পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, সহযোগিতা এবং এক সাথে পথ চলার সুগম হয়ে উঠে।”
“এই সিনোডের মধ্যদিয়ে যুগান্তকারী একটি পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করতে পারি। আর এই পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সার্বজনীন সংলাপ, পরস্পরের সংস্কৃতির প্রতি সন্মানবোধ”, বলেন ফাদার জর্জ প্লাথোটাম, এসডিবি।
এছাড়াও তিনি এশিয়া মহাদেশের বাস্তবতার আলোকে এশিয়ায় সিনোডালিটি বিষয়ক চিন্তা, মণ্ডলীতে নারীর সম্পৃক্ততায় সমস্যা, যুবদের নিয়ে ভাবনা, দরিদ্রদের বিষয়ে ভাবনা, যাজকতন্ত্রবাদের (ঈষবৎরপধষরংস) উত্তেজনা, অভিবাসী, উদ্বাস্তু এবং বাস্তুচ্যুতজনগণ, অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং আতিথেয়তা ও এশিয়ার কৃষ্টি-সংস্কৃতির আলোকে ‘জুতা খোলা’: এশিয়ান সিনোডাল যাত্রা বিষয়ে সহভাগিতা করেন।
ভাটিকানের সিনড বিষয়ক আণ্ডার সেক্রেটারী (অধীন সচিব) সিস্টার নাতালি বেককুয়ারর্ট এক্স,এম,সি,জে বলেন, “সিনোডালিটি হচ্ছে মণ্ডলীর গতিশীল দর্শন। আর গতিশীল দর্শনের পরিচয় চলমান লক্ষ্য নির্ধারণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। এছাড়াও সিনোডালিটি হচ্ছে ত্রিত্ব পরমেশ্বরের দর্শনের মতো; যুগের পরিক্রমায় মানুষের পরিত্রাণের জন্য পিতা, পুত্র ও পবিত্রাত্মা যেমন কাজ করেছেন তেমনি সিনোডাল মণ্ডলী যুগের চাহিদা পূরণে কাজ করে। যিশু যেমন শিষ্যদের সাথে এম্মাউসের পথে যাত্রা করেছেন তেমনি সিনড হচ্ছে যিশুর সাথে যাত্রা।”
তিনি আরো বলেন, এই সেমিনারে আলোচনার প্রতিটি ধাপে সিনড প্রক্রিয়ার আলোকে ব্যক্তিগত অনুধ্যানে পবিত্র আত্মার কণ্ঠস্বর শুনে দলীয় আলোচনার মধ্যদিয়ে প্রশ্নের উত্তর লিপিবদ্ধ এবং দলীয় উপস্থাপন করা হয়।”
“এই সিনোডালিটির প্রক্রিয়া হল কিছু করার মধ্য দিয়ে শেখা । অর্থাৎ সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে আমরা শিখব এবং এর মধ্য দিয়ে আমরা একে অন্যের হৃদয়ের কাছে পৌছাঁব”,বলেন সিস্টার নাতালি।
ঢাকা ধর্মপ্রদেশের আর্চবিশপ বিজয় এন. ডি‘ ক্রুজ বলেন, “খ্রিষ্টমন্ডলীতে খ্রিষ্টর বাণী অনুসারে জীবন যাপন করা তার শিক্ষা প্রচার করা এবং খ্রিষ্টিয় সেবা দান করাই হল সিনোডাল মন্ডলীর প্রক্রিয়ার মূল বিষয়। যীশু খ্রিষ্ট যেমন আর্ত পীড়িতদের কথা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন তেমনি ভাবে আমাদের ও অন্যের কথা মনযোগ দিয়ে শুনতে হবে। আমাদের অন্তরে অন্যকে গ্রহণ এবং বরণ করে নিতে হবে।”
আর্চবিশপ তার অধিবেশনের সহভাগিতায় ‘সিনডের অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর সিনোডাল যাত্রা’ মূলভাবের ওপর আলোচনা করে বলেন, “মণ্ডলী কী, সিনড বিষয়ে পোপ ফ্রান্সিসের মাণ্ডলীক চিন্তা, সিনডের কয়েকটি বিশেষ দিক এবং সিনোডাল মণ্ডলী গড়ার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ বিষয়ে আলোকপাত করেন।”
আর্চবিশপ আরো বলেন, “মণ্ডলী শুধুমাত্র ফাদার, ব্রাদার এবং সিস্টারদের নয়; আমরা সবাই মণ্ডলী। বাংলাদেশ কাথলিক মণ্ডলীতে সংঘ-সমিতির মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিবাদ, দেশে বিরাজমান অশুভ রাজনৈতিক প্রভাব ও মূল্যবোধের মতই ক্ষমতা, অর্থ, দলাদলি, অসহনশীলতার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। পোপ ফ্রান্সিসের চিন্তা প্রসূত সিনোডাল মণ্ডলীর আলোকে অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ গড়ে তুলতে পারলে এই সমস্যা দূর হবে।”
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব পিউস কস্তা তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, “অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ভাইবোনদের সাথে আমার পথচলা। তাই অন্যদের সাথে আমার সিনোডালিটি রক্ষা করতে হয়। আমি অন্যদের বলি, আমরা সবাই সৃষ্টিকর্তার সেবক। তেমনি আমিও আপনাদের সেবক হিসাবে কাজ করি। এই সেমিনার থেকে আমি যা অভিজ্ঞতা করেছি তা আমার কর্মজীবনে প্রতিফলন ঘটাবো বলে আশ্বাস দিচ্ছি।”
সেমিনারে অংশগ্রহণকারী যিশুর কন্যা সম্প্রদায়ের সিস্টার লোরি বলেন, “পবিত্র আত্মা আমাদের পরিচালনা ও শক্তিদান করেন। তাই বাংলাদেশ মণ্ডলীর আলোকে সিনোডালিটি প্রতিষ্ঠা করতে গেলে পবিত্রাত্মার সাহচর্য দরকার।”
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী মিসেস রীতা রোজারিও বলেন, “সিনড এবং সিনোডালিটি আমাদের মন্ডলীর জন্য নতুন একটি জাগরণ। পুন্য পিতা আমাদের জন্য নতুন একটি দ্বার উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন আর এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা পরস্পরের কাছে যেতে পারব এবং মনযোগ দিয়ে অন্যদের কথা শুনব।”
সমাপণী খ্রিষ্টযাগ উৎসর্গ করেন বাংলাদেশে দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাটিকানের রাষ্ট্রদূত আর্চবিশপ কেভিন রান্ডাল। তিনি তার উপদেশ বাণীতে বলেন, “পুন্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস আমাদের মন্ডলীর সবার মাঝে সুন্দর একটি যোগসূত্র তৈরি করার জন্য সুন্দর একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন । যাতে আমরা সবাই অন্যের কথা শ্রবণ করার জন্য একটি ভাল হৃদয় তৈরি করি।”
মিস দোলা বাড়ৈ তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, “এই সিনোডালিটি একটি নতুন সম্ভাবনার একটি দ্বার এবং প্রত্যাশার একটি স্থান যা আমাদের যুবাদের জন্য মন্ডলীতে অবদানের ক্ষেত্রকে আরো জোরালো করে তুলবে।” - আরভিএ সংবাদ