পবিত্র রমজান ও ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষ্যে ভাটিকানের আন্তঃধর্মীয় সংলাপ বিষয়ক দপ্তরের শুভেচ্ছা বাণী

প্রিয় মুসলমান ভাই ও বোনেরা,
রমজান মাসের শুরুতেই ভাটিকান রাষ্ট্রে অবস্থিত পোপীয় আন্তঃধর্মীয় সংলাপ দপ্তর তথা ডিকাস্টারী আপনাদের জনায় উষ্ণ ও বন্ধুসুলভ শুভেচ্ছা।
রোজা বা উপবাস, প্রার্থনা ও সহভাগিতা এই সময়টি হল ঈশ্বরের আরো কাছে আসার এবং ধর্মীয় কতকগুলো মৌলিক মূল্যবোধ দয়া-করুণা ও ঐক্যবদ্ধতায় নিজেদের জীবন নবায়ন করার একটি উত্তম সুযোগ।
এই বছর খুবই কাছাকাছি সময়ে শুরু হচ্ছে রজমান ও খ্রীষ্টিয় উপবাস বা তপস্যকাল যা খ্রীষ্টবিশ্বসীদের জন্য উপবাস, প্রার্থনা ও খ্রীষ্টে মনপরিবর্তন করার একটি সময়।
এই বছর পবিত্র রমজান ও ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষ্যে মূলসুর হিসেবে বেঁছে নেওয়া হয়েছে, “খ্রীষ্টান ও মুসলমানগণ : একত্রিত হয়ে উঠতে আমরা যা আশা করি”।
উপাসনার পঞ্জিকার সময়ের এই নৈকট্য খ্রীষ্টান ও মুসলমানদের একটি সাধারণ ধারায় শুদ্ধি, প্রার্থনা ও দয়ার কাজের মধ্য দিয়ে একসাথে পাশাপাশি পথ চলার সুযোগ করে দেয়।
আমরা যারা কাথলিক খ্রীষ্টান, আমাাদের জন্য আপনাদের সাথে এই সময় বা কালটি সহভাগিতা করা হল আমাদের আানন্দ; কেননা এই কালটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এই পৃথিবীতে আমরা সবাই তীর্থযাত্রী এবং এই তীর্থযাত্রায় আমরা অধিকতর উত্তম জীবনযাপন করার অবিরাম প্রচেষ্টা চালাই।
এই বছর কীভাবে আমরা একসাথে অধিকতর উত্তম জীবন-যাপন করতে পারি, শুধু এই বিষয়টি নিয়েই আপনাদের সাথে অনুধ্যান করতে চাই না, কিন্তু সর্বপরি বর্তমান এই আশা-অন্বেষী পৃথিবীতে কীভাবে আমরা খ্রীষ্টান ও মুসলমানগণ একত্রিত হয়ে উঠতে চাই , এই বিষয়টিও সহভাগিতা করতে চাই। আমরা কি নিছক একটি অধিকতর উত্তম জগত গড়ার কর্মী হতে চাই, নাকি সকল মানবজাতির সাথে ঈশ্বরের বন্ধুত্ব-এর সাক্ষ্য বহন ক’রে প্রকৃত অর্থেই ভাইবোন হয়ে উঠতে চাই?
নিছক রোজা বা উপবাসের মাসের চাইতে, আমরা, কাথলিক যারা, আমাদের কাছে রমজান উপস্থিত হয় অন্তরের অন্তস্থলের পরিবর্তন বা রূপান্তর হিসাবে। খাদ্য ও পানীয় ত্যাগ করে মুসলমানগণ তাদের কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণ করার সাধনা করে এবং সেই দিকেই ফিরে আসে যা নিতান্তই মাত্র প্রয়োজন। আধ্যাত্মিক শৃংখলার এই সময়টি আমাদের ঈশ্বরভক্তি মূল্যবোধটি কর্ষণ বা চর্চা করার আহবান জানায় যা আমাদেরকে ঈশ্বরের আরো কাছে নিয়ে আসে এবং অপরের প্রতি আমাদের হৃদয় উন্মুক্ত করে দেয়।
আপনারা জানেন যে, খ্রীষ্টধর্মের ঐতিহ্যে, পবিত্র উপবাস বা তপস্যকাল একই ধরণের পথ অনুসরণ করার আমন্ত্রণ জানায় : উপোস, প্রার্থনা ও ভিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে আমরা আামাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার পথ খুঁজি, চেষ্টা করি এবং সেই তাঁর দিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করি যিনি আমাদের জীবনকে পরিচালনা করেন, দিকনির্দেশনা দেন।
এই আধ্যাত্মিক অনুশীলনসমূহ, যদিও ভিন্নতরভাবে প্রকাশিত, আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ধর্মীয় বিশ্বাস শুধুই একটি বাহ্যিক প্রকাশই নয়, পক্ষান্তরে এটি হল অন্তর-গভীরের পরিবর্তনের এই উপায়।
বর্তমান পৃথিবী যা অন্যায্যতা, বিরোধ ও ভবিষ্যতবিষয়ে অনিশ্বয়তা দ্বারা চিহ্নিত এই পৃথিবীতে আমাদের সবার আহ্বানে যা অন্তর্ভূক্ত করে তা শুধু একই ধরণের আধ্যাত্মিক অনুশীলনের চাইতেও অধিক কিছু। আমাদের পৃথিবী ভ্রাতৃত্ব ও খাঁটি সংলাপের জন্য তৃষিত, আশান্বিত।
খ্রীষ্টান ও মুমলমানগণ একসাথে পারে এই আশার সাক্ষ্য বহন করতে এই প্রত্যয়ে যে ইতিহাসের বোঝা এবং বহির্ভূত-করে-রাখাকে সমর্থন করে, এমনসব মতবাদ থাকা সত্বেও বন্ধুত্ব সম্ভব। আশা এখন আর আশাবাদ নয়, এটি একটি গুণ বা মূল্যবোধ যা যিনি সর্বশক্তিমান, দয়ালু ও আমাদের সৃষ্টিকর্তা সেই ঈশ্বর-বিশ্বাসের মূল শিকড়ে গাঁথা।
প্রিয় মুসলমান বন্ধুগণ, বিশ্বাস ঐশকরুণা দ্বারা পুষ্ট হয়, একে রক্ষা করে, পরিচালনা করে। আর খ্রীষ্টানদের জন্য আাশার ভিত্তিমূল হল এই নিশ্চত প্রত্যয় যে ঈশ্বরের প্রেম সকল প্রকার পরীক্ষা ও বাধা-বিপত্তির চাইতেও অধিক শক্তিশালী।
তাহলে আমরা চাই যে, মানবতায় ভাই ও বোন হয়ে একত্রিত হয়ে উঠতে যারা একে অন্যকে সন্মান-স্বীকৃতি দান করে। ঈশ্বরে আমাদের বিশ্বাস হল একটি সম্পদ যা আমাদের পার্থক্যসমূহেরও উর্ধ্বে গিয়ে আমাদেরকে একত্রিত করে দেয়।
এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আমরা সবাই ্আধ্যাত্মিক, দেহধারী, প্রেমময় সৃষ্টি, যারা মর্যাদা ও পারস্পরিক সন্মান নিয়ে বসবাস করার জন্য আাহুত। আরো অধিক হল/অধিকন্তু , আমাদের ইচ্ছা-আাকাংখা এই পবিত্র মর্যাদার অভিভাবক হয়ে ওঠার বাসনা, আার তা সকল ধরণের বিরোধ, বৈষম্য ও বহির্ভূক্তকরণ পরিত্যাগ করেই।
এই বছর রমজান ও তপস্যাকাল আমাদের দুটি ধর্মীয় ঐহিহ্য একসঙ্গে একই বিন্দুতে বিদ্যমান, তখন বিশ্বকে দেখাবার আমাদের রয়েছে একটি একক/অপূর্ব সুযোগ যে বিশ্বাস জনগণ ও সমাজকে বদলে দিতে পারে ; আর এটিই হল একতা/ঐক্য ও পূণর্মিলনের একটি বেগবান শক্তি।
একটি পৃথিবী যেখানে “প্রাচীরের সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রলোভন, দেয়াল গড়ে তোলার , হৃদয়ে দেয়াল নির্মানের, দেশে দেয়াল নির্মানের, যেন আমরা অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে, অন্য জনগণের সঙ্গে, এই সাক্ষাতকে প্রতিরোধ করতে পারি” এমন প্রলোভন যেন আবার দেখা দিচ্ছে (পোপ ফ্রান্সিস, ভ্রাতৃসকল ২৭), সেখানে আমাদের চ্যালেঞ্জ হল সংলাপের মধ্য দিয়ে এমন একটি ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা যার ভিত্তিমূর হল ভ্রাতুত্ব।
আমরা শুধুই সহাবস্থানই করতে চাইনা, আমরা চাই সততা ও পারস্পরিক সম্প্রীতিতে একসাথে বসবাস করতে। বিভিন্ন মূল্যবোধ, যেমন ন্যায্যতা, করুণা এবং সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধা, এগুলো আমাদের কাজ ও সম্পর্ককে উৎসাহিত করা উচিত এবং দেয়াল নির্মানের চাইতে সেতুবন্ধন স্থাপন, বিবাদ-বিরোধের চাইতে ন্যায্যতা প্রতিরক্ষা, পরিবেশ ধংসের চেয়ে এর সুরক্ষা করার লক্ষ্যে আমাদের দিকনির্ণয় যন্ত্রের মতই কাজ করা উচিত।
আমাদের বিশ্বাস এবং এর মূল্যগুলো আামাদের সহায়ক হবে এমনই কণ্ঠস্বর হতে যা অন্যায়-অন্যায্যতা ও ঔদাস্য এগুলোর বিরুদ্ধে উচ্চরবে কথা বলবে এবং মানবব বৈচিত্রের সৌন্দর্য ঘোষণা করবে।
এই পবিত্র রমজানকালে এবং সমাগত ঈদ-উল-ফিতর উৎসবে আমরা এই আশা আপনাদের সাথে অংশভাগী করে আমরা খুশী ও আানন্দিত। আমাদের প্রার্থনা ও ঐক্যের প্রতিকী চিহ্নগুলোএবং শান্তির জন্য আমাদের প্রচেষ্টাসমূহ হয়ে উঠুক আাপনাদের সাথে আমাদের ভ্রাতৃত্বের দৃশ্যনীয় চিহ্ন।
এই মহোৎসব হয়ে উঠুক মুসলমান ও খ্রীষ্টানদের ভ্রাতৃতপূর্ণ/ভ্রাতৃপূর্ণ সাক্ষাত করার/মুখেমুখি হওয়ার একটি সুযোগ/উপলক্ষ, যেখানে আমরা একত্রে উযাপন করতে পারি ঈশ্বরের মঙ্গলময়তা। সহভাগীতার এমন একদম সাধারণ কিন্তু সুগভীর মুহূর্তগুলো হল আাশার বীজ যা আমাদের সমাজ ও গোটা বিশ্বকে বদলে দিতে পারে।
আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে উঠুক সতেজময় ঝিরিঝিরি বায়ু এমন এক পৃথিবীর জন্য যা শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের জন্য তৃষিত !
এই রমজান চলাকালে আপনাদের রোজা/উপবাস ও অন্যান্য ভক্তিময় অনুশীলন এবং পবিত্র ঈদুল-ফিতর উদযাপন যা রমজানকালের উপসংহার /সমাপ্তি, আপনাদের জন্য নিয়ে আসুক শান্তি, আাশা, ভ্রাতৃত্ব ও আনন্দের ফলভাণ্ডার/সুপ্রচুর ফলাফল। - (ভাটিকান থেকে প্রেরিত ৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, জর্জ যাকোব কার্ডিনাল কূভাকাদ, দপ্তর প্রধান এবং মন্সিনিয়র ইন্দুনিল কাদিথুওয়াক্কু জানাকারাৎনে কানকানামালাগে, দপ্তর সচিব)