আমাদের সম্পর্কে
রেডিও ভেরিতাস এশিয়া (আরভিএ) বাংলা বিভাগ রেডিও শর্ট ওয়েভ সম্প্রচার এশিয়ার শ্রোতাদের জন্য ১ ডিসেম্বর ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা থেকে শুরু করা হয়।
আরভিএ বাংলা সম্প্রচারের ধারণা শুরু হয় ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে যখন মানিলা থেকে ফাদার এ্যন্টন ওয়েরাসিংহে, বোম্বের (অধুনা মুম্বাই) জেভিয়ার ইনস্টিটিউট অফ কমিউনিকেশনের ফাদার গ্রেরী ডি’ রোজারিও কলকাতার চিত্রবাণীতে আসেন এবং ফাদার গ্যাস্টন রোবার্জের (তখন চিত্রবাণীর অধিকর্তা) সাথে চুক্তি করেন যে- চিত্রবাণীর সঙ্গে যৌথভাবে রেডিও ভেরিতাস বাংলা বিভাগ পরিচালনা করবে, এশিয়ার মানুষের কাছে বাংলায় সত্য, শান্তি ও ভালবাসার বাণী প্রচারের জন্য।
৪ জুলাই ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ, ফাদার রোবার্জ তাঁর প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে কলকাতার মহাধর্মপালের অনুমতি চান। তখনকার মহাধর্মপাল স্বর্গীয় এ্যালান ডি লাস্টিক (তখন কলকাতার আর্চডায়োসেসের ভীকার জেনারেল) ২৯ জুলাই ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ, অনুমতিপত্র প্রদান করেন বাংলায় রেডিও অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য। চিঠিতে আরও বলা হয় এই কাজকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য একটি সহ উপদেষ্টা কমিটি গঠন করতে হবে। স্থানীয় বিশপগণ কিছু আর্থিক সাহায্যেরও আশ্বাস দেবেন বলে ওই চিঠিতে জানানো হয়।
১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে স্বর্গীয় জয়ন্ত চৌধুরী (ভয়েস অফ আমেরিকার প্রাক্তন পরিচালক) রেডিও ভেরিতাস বাংলা অনুষ্ঠান পরিচালনা শুরু করেন। ১ ডিসেম্বর ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে রেডিও ভেরিতাস এশিয়ার বাংলা বিভাগ ড. রমেন মজুমদারের তত্ত্বাবধানে ম্যানিলা থেকে সম্প্রচার শুরু হয়।
পূর্বে কলকাতার চিত্রবাণী মিডিয়া সেন্টার এবং বর্তমানে এখন কলকাতার বিআরবিসি ও বাংলাদেশের বাণীদীপ্তি যৌথভাবে বাংলা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে আসছে। সাময়িকভাবে কলকাতার নিকিতা ডন বস্কো মিডিয়া সেন্টারও এই কাজে রেডিও ভেরিতাসের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ভারত ও বাংলাদেশের অগণিত বাংলাভাষী মানুষ যারা সত্য ও ভালবাসার আন্বেষণ করে তারা জীবনের প্রতি পদে রেডিও ভেরিতাস বাংলাকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে চলেছে।
আমাদের পূর্বসূরীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনায় বাংলা সম্প্রচার উচ্চমানের ও উচ্চপর্যায়ের অনুষ্ঠান করতে সচেষ্ট আছে। মহামান্য বিশপ এ্যালান ডি লাস্টিকের তত্ত্বাবধানে যে আঞ্চলিক কমিটি গঠন করা হয় তা ‘রেডিও ভেরিতাস বাংলা বিভাগীয় কাউন্সিল’ নামে পরিচিত। এই কাউন্সিল বাংলা বিভাগের সমস্ত অনুষ্ঠান নির্ধারণ করেন ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিবর্তনের প্রয়োজন থাকলে তা করে থাকেন। রেডিও ভেরিতাস বাংলা বিভাগ যা মানুষের জীবনের কথা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ, হাসি-কান্না, সংস্কৃতি, ভ্রাতৃত্ববোধ, সম্প্রীতি ও মনুষ্যত্বের কথা বলে আসছে। সত্য, জ্ঞান, ভালবাসা ও ঐশ্বরিক আলো রেডিও ভেরিতাস এশিয়ার বাংলা বিভাগের মধ্যদিয়ে সবার অন্তরে প্রজ্জ্বলিত হোক।
আরভিএ ইতিহাস
রেডিও ভেরিতাস এশিয়া (আরভিএ), একটি স্বপ্ন হিসেবে শুরু হয়, বিশ্বজগতের সকল কোণে খ্রিস্টের বাণী অনুসরণ করে, খ্রিস্টকে সকলের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য এটি একটি প্রয়াস। এর প্রধান লক্ষ্য এশিয়া মহাদেশের সমস্ত মানুষের জন্য ছিল- রেডিওর মাধ্যমে বেতার ব্যাবস্থাকে কাজে লাগিয়ে খ্রিস্টের সত্য ও ভালোবাসার কথা ঘোষণা করা ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া মহাদেশটি এমন ভয়াবহ আতঙ্কের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল যাতে মানুষের স্বপ্ন ব্যাহত হয়েছিল। চীন এবং তার দক্ষিণ প্রতিবেশী ভিয়েতনাম, কোরিয়া এবং বার্মার বিস্তৃত জায়গায় কমিউনিস্টদের মন্দ প্রভাবে মানব মর্যাদার ভিত্তি কেঁপে ওঠে। এই বর্বরোচিত নিষ্ঠুর সময়টা শত শত মানুষের প্রাণ কেড়ে ন্যায়, মানুষের স্বাধীনতায় আঘাত হানে এবং খ্রিস্ট বিশ্বাসের জীবন বাঁচানোর সমস্ত প্রচেষ্টাকে চূর্ণ করে। সরকার মানুষের মৌলিক মানব মর্যাদার বিরোধিতা করায় জনগণের একমাত্র প্রত্যাশা ছিল খ্রিস্ট ও তাঁর কণ্ঠস্বর বা বাণী। রেডিওর মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে মানুষের প্রত্যাশা ও নব অঙ্গীকারের বার্তা বাহক হয়ে উঠলো এই প্রয়াস। মানুষের বেঁচে থাকার রসদ তারা পেল এই রেডিও থেকে।
এশিয়ার চার্চের প্রতিক্রিয়া
১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে, ম্যানিলার সান্ত টমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল সেকেন্ডারি এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া থেকে ১০০ জন বিশপের একটি সমাবেশে এই স্বপ্ন উপস্থাপন করা হয়েছিল। অবশেষে এই ধারণাটি ভ্যাটিকানের সম্মতির সাথে অনুমোদিত এবং গৃহীত হয়। পোপ দ্বাদশ পিউসের এশিয়াতে একটি মহাদেশীয় ক্যাথলিক রেডিও স্টেশন স্থাপনের ইচ্ছা সেই সময় ছিল। তার মৃত্যুর পর, তার চিন্তাধারা পোপ জন ২৩শ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল, যিনি তার প্রতিনিধি রূপে ১১শ গ্রেগরি পিটার এবং কার্ডিনাল আ্যাগাগিয়ানকে এশিয়া চার্চে কমিউনিজমের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করার জন্য পাঠিয়েছিলেন।
ফিলিপাইন, চীনের নিকটবর্তী এশিয়ায় একমাত্র ক্যাথলিক দেশ, তাই এই দেশ থেকেই রেডিও অনুষ্ঠান আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। কার্ডিনাল রফিনো সান্তোস, যিনি তখন ম্যানিলার আর্চবিশপ ছিলেন, তিনি এতে সম্মতি প্রদান করেন। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে, ম্যানিলাতে রেডিও ভেরিতাসের জন্য একটি আইনগত সংস্থা তৈরি করা হয়েছিল। এটি ছিল ফিলিপাইন রেডিও এডুকেশনাল এন্ড ইনফরমেশন সেন্টার (এফআইআরসি) যা আরভিএ-র জন্য আইনি ব্যাবস্থা প্রদান করেছিল।
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পোপ ষষ্ঠ পল এই কথাগুলো দিয়ে ম্যানিলাতে রেডিও ভেরিতাস এশিয়ার সম্প্রচার উদ্বোধন করেন: "এই মহান উদ্যোগ এবং এই গুরুত্বপূর্ণ কাজকে খ্রিস্টের শিক্ষার প্রতিধ্বনি করা উচিত যেনো ঈশ্বরের সত্য ও প্রেম মানুষের হৃদয় উজ্জ্বল করে তুলতে হবে।" ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে পোপ ২য় জন পল আরভিএ পরিদর্শন করেন এবং আরভিএ-কে "এশিয়ার খ্রিস্টধর্মের মুখপাত্র" হিসাবে বর্ণনা করেন ও শর্ট ওয়েভ স্টেশনটির প্রাসঙ্গিকতা সীলমোহর করেন। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে পোপ "একলেশিয়া ইন এশিয়া"-তে রেডিও ভেরিতাসকে একটি "মিশন এর চমৎকার যন্ত্র" হিসেবে উল্লেখ করেন।
ঈশ্বরের উদারতা
ঈশ্বরের উদারতা এই প্রকল্প বাস্তবায় ছিল অনস্বীকার্য কারণ জার্মান চার্চ এগিয়ে এসেছিলো এশিয়ান বিশপদের মহান এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ১১ অক্টোবর, জার্মানির চ্যান্সেলর কনরাড অ্যাডেনউয়ার রেডিও ভেরিটাস এশিয়াকে এই স্বপ্ন প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন।
এশিয়ার কিছু বিশপ কনফারেন্সও এই মহান মিশনারি উদ্যোগের জন্য তাদের সংহতি প্রকাশ করেছেন। জাপান, কোরিয়া এবং থাইল্যান্ডের বিশপ সম্মেলনী এই উদ্যোগ সমর্থন করে এগিয়ে আসেন। অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য স্টুডিও ঘর ও অন্যান্য কাজের জন্য, ম্যানিলার আর্চডায়োসিস মেট্রো ম্যানিলার ক্যাজন সিটি এলঅকার ফেয়ার ভিউ নামক স্থানে সম্পত্তি বরাদ্দ করেন। ১৯৭০-এর দশকে মায়ানমারে পোপ ৬ষ্ঠ পল-এর ঐতিহাসিক সফরে ফেডারেশন অফ এশীয় বিশপ কনফারেন্সের (এফএবিসি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তখন থেকেই স্টেশনটির দায়িত্ব এশিয়ার বিশপদের হাতে দেওয়া হয়েছিল। এই সামাজিক যোগাযোগের জন্য এফ.এ.বি.সি বা ফেডারেশন অফ এশিয়ান বিশপ কনফারেন্স অফিসের মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে। পাঁচটি বিশপ এবং নির্বাহী সচিবের বোর্ড পরিকল্পনাটি পরিচালনা ও স্টেশনটি চালানোর জন্য নিরাপদ অর্থ সাহায্যের দায়িত্বে ছিলেন।
আরভিএ এবং প্রযুক্তিগত বিপ্লব
আজকের প্রযুক্তিভিত্তিক বিশ্বের মধ্যে, রেডিও প্রযুক্তি পিছনে পড়ে নেই। সেই চিন্তা মাথায় রেখে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় অনুষ্ঠান চালু করা হয়, যাতে ইন্টারনেট এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে যে কোনও সময় এবং যে কোনও জায়গায় এশিয়ার দেশগুলিতে মানুষ তা শুনতে সক্ষম হন। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে, আরভিএ তার অনুষ্ঠান সম্প্রচার ও অনুষ্ঠান তৈরির সুযোগগুলিকে ডিজিটাল করে দেয়, যা ভাষার স্থানান্তরের পথ তৈরি করে, যেখানে যেভাবে কেন্দ্রগুলো সুবিধা মনে করে। উপরন্তু, এই উন্নয়ন স্থানীয় অঞ্চলে উৎপাদিত করা বেশিরভাগ প্রোগ্রামের জন্য সম্ভাবনা তৈরি করে এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে আরভিএ স্টুডিওগুলিতে প্রেরণ করে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ১ জুলাই ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে সম্পূর্ণ ডিজিটাল অন লাইন রেডিও অনুষ্ঠান পরিচালনা করে আসছে, তবে শুধু এশিয়ার জন্য নয় বরং বিশ্বের সকল মানুষের কাছে রেডিও ভেরিতাস সত্য, শান্তি, ভালোবাসা, একতা ও সম্প্রীতির বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে।