কার্ডিনাল ট্যাগলে: এশীয় খ্রীষ্টমন্ডলীর আরও বেশি জ্ঞানী পন্ডিতদের প্রয়োজন, হেরোদদের নয়

পেনাং, মালয়েশিয়ায় ‘গ্রেট পিলগ্রিমেজ অব হোপ’-এ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আগত এক হাজারেরও বেশি প্রতিনিধির সামনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কার্ডিনাল লুইস আন্তোনিও ট্যাগলে খ্রীষ্টমন্ডলীকে তিন পন্ডিতদের আদর্শকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান।


তিনি বলেন, তিন পন্ডিতরা হলেন সেই তীর্থযাত্রী যারা খোঁজেন, শোনেন এবং বিনয়ের সাথে পথ চলেন। এর ঠিক বিপরীতধর্মী হেরোদ  ভয়, ক্ষমতার লালসা এবং আত্মরক্ষার মনোভাব আঁকড়ে ধরেছিলেন—এই মনোভাব মন্ডলীকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।

বিগত নভেম্বর ০২৫,গ্রেট পিলগ্রিমেজ অব হোপ পেনাং, মালয়েশিয়ায় উদ্বোধন করা হয়। যা, গত কুড়ি বছরে এশীয় খ্রীষ্টমন্ডলীর সবচেয়ে বড় সমাবেশ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর পবিত্র খ্রীষ্টযাগ উৎসর্গ করা হয়, যা প্রতিনিধিত্ব করেন পেনাংয়ের বিশপ ও আয়োজক ডায়োসিসের প্রধান কার্ডিনাল সেবাস্টিয়ান ফ্রান্সিস।

প্রথম দিনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল বিশিষ্ট বক্তৃতা, যা প্রদান করেন ডিকাস্টারি ফর ইভানজেলাইজেশনের “ফার্স্ট ইভানজেলাইজেশন সেকশন”-এর প্রো-প্রিফেক্ট, মহামান্য কার্ডিনাল লুইস আন্তোনিও ট্যাগলে। তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল—“এক ভিন্ন পথে, আশার আলোয় নতুনভাবে পথচলা যাত্রীরা

খ্রিষ্টীয় আশা: একটি উপহার যা জীবনকে পরিশুদ্ধ করে এবং নতুন পথে পরিচালিত করে

কার্ডিনাল ট্যাগলে তাঁর প্রাণবন্ত বক্তব্যে স্মরণ করেন ২০০৬ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত প্রথম কংগ্রেসের অভিজ্ঞতা। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে এশিয়ার ক্যাথলিকদের কখনোই “যীশুর গল্প বলার সময় ক্লান্তি আসা উচিত নয়— কারণ এই গল্প আজও আমাদের জীবন, সংস্কৃতি ও সমাজকে প্রভাবিত করে চলছে।

নিজের বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশে আশার আলোয় নতুনভাবে পথচলা যাত্রীরা—এই বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, আশা কেবলমাত্র একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, অবাস্তব আশা বা জীবনের কঠিনতা থেকে পালানোর উপায় নয় বরং, খ্রিষ্টীয় আশা একটি ধর্মতাত্ত্বিক গুণ, যা ঈশ্বর দ্বারা সঞ্চারিত এবং যার উৎস ও লক্ষ্য—ঈশ্বর নিজেই।”

ক্যাথলিক মন্ডলীর ধর্মদর্শনের (Catechism of the Catholic Church, 1818) উদ্ধৃত করে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে আশা প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ে সুখের আকাঙ্ক্ষার বীজ বপন করে, প্রতিটি পরীক্ষার মুহূর্তে নিজেদের শক্ত করে ধরে রাখতে সাহায্য করে, ভালোবাসাকে পরিশুদ্ধ করে এবং আকাঙ্ক্ষাগুলিকে ঈশ্বরের রাজ্যের দিকে পরিচালিত করে। প্রকৃত আশা অধ্যবসায়কে শক্তিশালী করে, স্বার্থপর উদ্দেশ্যগুলিকে পরিশোধিত করে এবং দানশীলতাকে নবায়িত করে।

ট্যাগলে প্রতিনিধিদের নিষ্ঠার সাথে আত্মসমীক্ষার আমন্ত্রণ জানান: তিনি বলেন-
*কি আমাকে প্রকৃত সুখ দেয়?
*আমার অধ্যবসায়ের প্রেরণা কী?
*আমার দানশীলতা কি সত্যিই ঈশ্বরের রাজ্যের জন্য, নাকি আমার নিজের সুবিধার জন্য?

তিনি বলেন, “খ্রিষ্টীয় আশা আমাদের হৃদয়কে এমনভাবে পরিশুদ্ধ করে যাতে ঈশ্বর যেমন আমাদের ভালোবাসেন, আমরাও যেন ঠিক সেইভাবে আমাদের প্রতিবেশীকে ভালোবাসতে পারি।”

“এক ভিন্ন পথে যাত্রা” এই প্রসঙ্গে কার্ডিনাল ট্যাগলে তিন পন্ডিতদের গল্প নিয়ে আলোচনা করে বলেন শিশু যীশুর সঙ্গে সাক্ষাতের পর পন্ডিতরা যে “অন্য পথে” ফিরে গিয়েছিলেন, এই গল্প এশিয়ার মানুষের জন্য এক বৈচিত্র্যময় অনুকরণীয় আদর্শ,  শুদ্ধ আকাঙ্ক্ষায় চালিত এক জনজীবনের গল্প।

তিনি তিন পন্ডিত ও হেরোদকে তুলনা করে দুই ধরনের তীর্থযাত্রার কথা বলেন:

যীশুর দিকে ধাবমান তীর্থযাত্রা, যা বিনয়, উন্মুক্ততা ও আলোর দ্বারা পরিচালিত
যীশু-শূন্য তীর্থযাত্রা, যা ভয়, স্থবিরতা ও সহিংসতার চিহ্ন বহন করে

শুরু থেকেই পণ্ডিতরা “এক ভিন্ন পথ” বেছে নিয়েছিলেন। যদিও তারা ভিন্ন জাতির লোক ছিলেন, তবুও তারা নিজেদের ব্যাপ্তির বাইরে গিয়েছিলেন, তারামণ্ডল পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, সৃষ্টির প্রতি মনোনিবেশ করেছিলেন, ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতিধ্বনি শুনেছিলেন। তাদের উন্মুক্ত মনই তাদের এই বিচার-বিবেচনার পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।

অন্যদিকে হেরোদ নড়লেনই না। ক্ষমতার প্রতি তার মোহ তাকে সৃষ্টি, ধর্মগ্রন্থ এবং অন্যদের আনন্দ দান থেকেও দূরে করে দিয়েছিল। ট্যাগলে বলেন, “যদি তোমার হাতে ক্ষমতা থাকে, তবে তোমার দম্ভ বৃদ্ধি পাবে; আর দম্ভ থাকলে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে” হেরোদের এই অচলতা “সংক্রামক” হয়ে ওঠে, তার আশেপাশের মানুষকেও ভয় ও নিষ্ক্রিয়তায় গ্রাস করে।

বিনয়, সহযাত্রা (সিনোডালিটি) এবং শেখার সাহস

দ্বিতীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যের কথা উল্লেখ করে ট্যাগলে বলেন, পণ্ডিতরা তাঁদের অজ্ঞতা স্বীকার করেছিলেন এবং সাহায্যপ্রার্থী হয়েছিলেন। তাঁদের ধর্মগ্রন্থ থেকে এবং জেরুজালেমের ধর্মীয় নেতাদের কাছ থেকে শেখার মানসিকতা ছিল। এই বিনয়ী মনোভাব সিনোডালিটি চেতনার সঙ্গে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ।

অন্যদিকে হেরোদ এবং তাঁর রাজসভাসদদের জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও সেই জ্ঞানের কোনো বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় নি। তাদের এই জ্ঞান কেবল ক্ষমতা রক্ষার কাজে ব্যবহৃত হতো, সত্যের পথে পরিচালিত করার জন্য নয়।

ট্যাগলে সতর্ক করে বলেন, “পবিত্র আত্মার দানগুলো তখনই নষ্ট হয় যখন সেগুলোকে উপেক্ষা করা হয়… অথবা যখন তা শুধু উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য ব্যবহৃত হয়, সাধারণ মঙ্গলের জন্য নয়।”

বেথলেহেমে আনন্দ খুঁজে পাওয়া, জেরুজালেমে নয়

ট্যাগলে তৃতীয় যে দিকটি তুলে ধরেন তা হলো প্রকাশিত সত্যের প্রতি পণ্ডিতদের তৎক্ষণাৎ সাড়া দেওয়া। ভবিষ্যদ্বাণী জানার পর তারা সাথে সাথেই যাত্রা শুরু করেন—ধর্মগ্রন্থ ও তারকার নির্দেশনা অনুসরণ করে—যতক্ষণ না তারা শিশু যীশুকে খুঁজে পান। তাদের আনন্দ পূর্ণতা পায় উপাসনায় এবং উপহার অর্পণে—“এমন এক ঈশ্বরকে উপহার, যিনি কষ্ট ভোগ করবেন।”

অন্যদিকে হেরোদ এই সংবাদে অস্থির হয়ে ওঠে। রাজকীয় জেরুজালেমে নয়, বিনম্র বেথলেহেমে নতুন রাজা জন্মাচ্ছে—এ খবর তাকে আতঙ্কিত করে তোলে। ফলে সে সহিংসতার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, এমনকি নিরপরাধ শিশুরাও রক্ষা পায় না। ট্যাগলে সতর্ক করে বলেন, “নিরাশ মানুষ আনন্দিত হয় না। তারা অন্যের আনন্দও সহ্য করতে পারে না।”

তিনি প্রতিনিধিদের—বিশেষ করে যাজক ও গির্জার ধর্মীয় নেতাদের—বেথলেহেম থেকে শেখার আহ্বান জানান: “আমরা যেসব ছোট ছোট সম্প্রদায়কে  অবহেলা করি, তাদের মধ্যেই অনেক জ্ঞান ও আনন্দ লুকিয়ে আছে।”

“আমাদের আরও পন্ডিত দরকার,  হেরোদ নয়

এক আবেগঘন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে কার্ডিনাল ট্যাগলে বলেন যে সম্প্রতি এক বিদেশ সফরে তিনি রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকে যাওয়ার পথে পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু সেই ভুলপথই তাকে দুইজন ফিলিপিনো অভিবাসী শ্রমিকের কাছে নিয়ে যায়—যারা তাকে চিনে ফেলেন, প্রার্থনা চান এবং নিজেদের সংগ্রামের কথা শোনান।তিনি বলেন, “আমি বুঝতে পারলাম আমি পথ হারাইনি। যীশুই আমাকে সেই পথে নিয়ে গিয়েছেন।”

তিনি জোর দিয়ে বলেন, খ্রিষ্টীয় তীর্থযাত্রার মূলমন্ত্র হলো:
“যীশু হলেন ভিন্ন পথযাত্রী, তিনিই পথ, সত্য ও জীবন। তিনিই আমাদের তারকা, আমাদের লক্ষ্য, আমাদের আশা।”

কার্ডিনাল ট্যাগলে এশিয়ার মন্ডলী গুলির উদ্দেশে আকুল আহ্বান জানিয়ে তাঁর বক্তব্য শেষ করে বলেন:

“আমাদের আরও পন্ডিতের দরকার—যারা খোঁজে, শোনে, শেখে এবং উপাসনা করে।
আমাদের  হেরোদের প্রয়োজন নেই —যারা ভয়, ক্ষমতার দম্ভ ও হতাশায় বন্দি। এসো, যীশুর তীর্থযাত্রায় যোগ দাও।”

প্রতিবেদন রেডিও ভেরিতাস এশিয়া

অনুলিখন তেরেজা রোজারিও