বাংলাদেশ ন্যাশনাল ওয়াইএমসিএ’র সুবর্ণ জয়ন্তীর উৎসব উদযাপন
গত ৩০ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, সাভার রেডিও কলোনীস্থ ওয়াইএমসিএ ইন্টারন্যাশনাল হাউজে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ওয়াইএমসিএ’র সুবর্ণ জয়ন্তীর উৎসব উদযাপন করা হয়।
শতাধীক যুবাদের উপস্থিতিতে উদ্বোধন করা হলো তিন দিনব্যাপী আয়োজিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল ওয়াইএমসিএ’র ৫০ বছরের সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল ওয়াইএমসিএ’র প্রেসিডেন্ট মার্সিয়া মিলি গমেজ এই জুবিলি বছরের সমাপনী অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন করেন।
এদিন প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি জেনারেল নিপুন সাংমা’র সঞ্চালনায় এশিয়া এন্ড প্যাসিফিক এলায়েন্স অব ওয়াইএমসিএএস’র ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল ওয়াইএমসিএ’র প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বাবু মার্কুজ গমেজ, ফাদার সেন্টু কস্তাসহ স্থানীয় ওয়াইএমসিএ’র নেতৃবৃন্দ এবং জেন্ডার ও ইয়ূথ এসেম্বলি’র শতাধীক যুবক-যুবতী উপস্থিত ছিলেন।
এদিন বিকেলে ওয়ার্ল্ড এ্যালায়েন্স অব ওয়াইএমসিএএস-এর সেক্রেটারি জেনারেল কার্লোস সানভি ইয়ূথ এবং জেন্ডার এসেম্বলি কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন।
বেলুন উড়িয়ে প্রেসিডেন্ট মার্সিয়া মিলি গমেজ জুবিলি উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে ওয়াএইএমসিএ’র ৫০ বছরের যাত্রা। তাই আমরা বলি, একত্রে পথ চলার ৫০ বছর। ওয়াইএমসিএ বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং সুপ্রাচীন যুব আন্দোলন।”
তিনি আরো বলেন, “যুবদের সার্বিক উন্নয়ন ও কল্যাণে ১৮৪৪ সালে যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে স্যার জর্জ উইলিয়ামস সমমনা ১২জন যুবককে নিয়ে ওয়াইএমসিএ যুব সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮১ বছর ধরে সংগঠনটি যুবাদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা সেই ওয়াইএমসিএ পরিবারের সদস্য।”
“যুব নেতৃত্ব, লিঙ্গ সমতা, কর্মসংস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়নসহ জাতিসংঘের ঘোষিত স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষমাত্রার সকল লক্ষ্য নিয়ে ওয়াইএমসিএ কাজ করে যাচ্ছে। যুবারা হলো এই সংগঠনের প্রাণ। আপনারাই পারবেন সুন্দর পৃথিবী গড়তে। তাই যুবাদের নিয়ে আমাদের সকলের এক সাথে পথ চলতে হবে,” বলেন মার্সিয়া গমেজ।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা ওয়াইএমসিএ আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে, কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর নব্য স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তখন তোরজোর চলছে।
১৯৭২ সালে বিশ্ব ওয়াইএমসিএ যুক্তরাজ্যের বিল হার্টকে বাংলাদেশে প্রেরণ করে যেন, সদ্য স্বাধীন দেশে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমগুলো পরিচালিত হয় এবং তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৭২ থেকে ৭৩ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম, বরিশাল, দিনাজপুর ও বিরিশিরি ৪টি স্থানীয় ওয়াইএমসিএ প্রতিষ্ঠিত হয়।
ওয়াইএমসিএ’র কার্যক্রম আরো সুনির্দিষ্ট এবং বেগবান করতে স্থানীয় ওয়াইএমসিএ’র নেতৃবৃন্দ প্রয়াত সুশান্ত অধিকারী, আলফ্রেড বি. আর. বাড়ৈ, আরনল্ড সি. গমেজ ও মাইকেল দাস একটি অভ‚তপূর্ব উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং সর্বপ্রচেষ্টায় ১৯৭৪ সালের ৩ মার্চ, দি ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ওয়াইএমসিএস অব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখান থেকেই বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি নতুন যাত্রা শুরু হয়।
উল্লেখ্য, মি. বিল হার্ট ছিলেন একজন দক্ষ ক্রীড়াবিদ, তিনি তৎকালীন সময়ে জনপ্রিয় আবহনী ক্লাবের প্রথম ফুটবল কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ‘দি ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ওয়াইএমসিএএস্ অব বাংলাদেশ’ সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন এ্যক্ট’র অধীনে নিবন্ধন লাভ করে।
১৯৭৪ সাল, ভয়াবহ প্রলঙ্কারী বন্যা ও জলোচ্ছাসে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় জনপদসমূহ। খাদ্যাভাবসহ নানাপ্রকার রোগ ও সংকটের কারণে জনজীবন বিপর্যের মুখে পড়ে।
তৎকালীন সময়ে অন্যান্য সাহায্য সংস্থার মতো ওয়াইএমসিএ বিভিন্ন জেলায় সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণসহ ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং আপামর জনগণের বিশ্বস্ত ও আস্থার প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে।
১৯৭৭ সালের আগস্ট মাসে বিশ্ব ওয়াইএমসিএ’র সেক্রেটারি জেনারেল রেভা: ফ্রেডরিক ফ্রাঙ্কলিন বাংলাদেশে ওয়াইএমসিএ’র কার্যক্রম পরিদর্শনে আসেন। তিনি স্থানীয় ওয়াইএমসিএসমূহের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম দেখ মুগ্ধ হন।
পরে ১৯৭৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরিশ শহরে অনুষ্ঠিত ওয়াইএমসিএ কাউন্সিল সভায় ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ওয়াইএমসিএএস্ অব বাংলাদেশ বিশ্ব ওয়াইএমসিএ’র পূর্ণ সদস্যপদ লাভের আবেদনপত্রটি চুড়ান্তভাবে গ্রহণ ও অনুমোদিত হয়। যা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ওয়াইএমসিএএস্ অব বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন হয়ে রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ন্যাশনাল ওয়াইএমসিএএস স্থানীয় ওয়াইএমসিএসমূহকে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ওয়াইএমসিএএস-এ ১৭ জন প্রেসিডেন্ট এবং ১১জন জাতীয় সাধারণ সম্পাদক সততা, নিষ্ঠা এবং দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে সংগঠনটিকে এক অনন্য মাত্রা দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ন্যাশনাল ওয়াইএমসিএ’র নেতৃবৃন্দসহ যুবরা বিশ্ব ওয়াইএমসিএ ও এপিএওয়াই-এর কাউন্সিল, ফোরাম, কনফারেন্সসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণে নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৮১ সালে ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের তৎকালীন আর্চবিশপ মাইকেল ডি’রোজারিও’র নেতৃত্বে চার্চ অব বাংলাদেশের বিশপ বিডি মন্ডলসহ আন্তঃধর্মীয় ও ওয়াইএমসিএ’র নেতৃবৃন্দ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে ওয়াইএমসিএ’র জন্য জমি প্রদানের অনুরোধ জানান।
১৯৯০ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মো. এরশাদ ঢাকা ওয়াইএমসিএ’র রজত জয়ন্তী উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে ঢাকা শহরের রমনা থানার অন্তর্গত ১/১, পাইওনিয়ার রোড কাকরাইলে ন্যাশনাল ওয়াইএমসিএএসকে দশমিক ২৫ একর জমি প্রদানের ঘোষণা দেন।
১৯৯৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটির শুভ উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব করেন ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ওয়াইএমসিএএস্ অব বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বাবু মার্কুজ গমেজ।
১৯৯৮ সালে দি ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ওয়াইএমসিএএস্ অব বাংলাদেশ’র কার্যালয় এই নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয় এবং পুরোদ্যোমে কার্যক্রম পরিচালনা করে।
যুবদের সার্বিক উন্নয়ন ও কল্যাণে ১৮৪৪ সালে যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে স্যার জর্জ উইলিয়ামস সমমনা ১২জন যুবকদের নিয়ে ওয়াইএমসিএ নামক এই যুব সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন।
যারা বিভিন্ন শিল্পকারখানায় কর্মরত ছিলেন তাদেরকে নিয়ে বাইবেল ক্লাস, পারিবারিক ও সামাজিক প্রার্থনা সভার আয়োজন করে তাদের আত্মিক উন্নয়ন সাধন করার লক্ষে শুরুর দিকে কাজ করেন।
পরবর্তী ১০-১২ বছরের মধ্যে যুব আন্দোলনটি পশ্চিম ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং ভারতে সম্প্রসারিত হতে থাকে। ১৮৫৫ সালে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ৯টি ওয়াইএমসিএ-র ৯৯ জন প্রতিনিধি নিয়ে প্রথম ওয়াইএমসিএ বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে যুবাদের নিয়ে গড়ে ওঠা সবচেয়ে বৃহৎ যুব আন্দোলন হিসেবে ওয়াইএমসিএ স্বমহিমায় নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে।
১৮৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস্ অবস্থিত স্প্রিংফিল্ড আন্তর্জাতিক ওয়াইএমসিএ প্রশিক্ষণ স্কুলের শরীর চর্চা শিক্ষক জেমস্ নেইস্মিথ বাস্কেটবল খেলা এবং ১৮৯৫ সালে ওয়াইএমসিএ প্রশিক্ষণ স্কুলের প্রশিক্ষক উইলিয়াম মরগান যুক্তরাষ্ট্রের হলিইয়কে ভলিবল খেলার আবিস্কার ও প্রচলন করেন। এই খেলা দু’টি সারাবিশ্বের জনপ্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
এ ছাড়াও বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান রাখার জন্য ১৯০১ সালে হেনরী ডুনান্ট, ১৯৪৬ সালে জন আর. মথ ও ২০০৮ সালে মর্টি আন্টিসারি নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভ‚ষিত হন। যা ওয়াইএমসিএ আন্দোলনের মধ্যে গৌরবের মুকুট হয়ে ফুঁটে রয়েছে।
এর আগে ২৬ জানুয়ারি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে, সাভার রেডিও কলোনীস্থ ওয়াইএমসিএ ইন্টারন্যাশনাল হাউজে জুবিলি উৎসবের ৫০ বছরের লোগো উন্মোচন ও ৫০টি প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে জুবিলি বছরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। - ডিসিনিউজ