দিয়াং মা মারিয়ার তীর্থের সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব উদযাপন

গত ১৩ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, চট্টগ্রাম কাথলিক আর্চডাইয়োসিসের দিয়াং মরিয়ম ধর্মপল্লীর মরিয়ম আশ্রমে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে মা মারিয়ার তীর্থের সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব উদযাপন করা হয়।
এই বছর মা মারিয়ার তীর্থোৎসবের মূলসুর ছিল, “মেষপালকের অনুগ্রহে মা মারিয়ার সাথে আনন্দ-যাত্রা”। এতে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত প্রায় ৮,০০০ তীর্থযাত্রীরা উপস্থিত ছিলেন।
তীর্থের আগের দিন বিকালে পবিত্র খ্রিস্টযাগের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তীর্থোৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা। এই দিন পবিত্র খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন চট্টগ্রাম কাথলিক আর্চডাইয়োসিসের আর্চবিশপ সুব্রত লরেন্স হাওলাদার, সিএসসি।
তিনি তার উপদেশ সহভাগিতায় সকল তীর্থযাত্রী ভাইবানদেরকে আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন,“ আমরা তীর্থযাত্রা করি পিতার সাথে আমাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ককে নবীকৃত করতে। সেখান থেকেই আসে জীবনের শান্তি ও আনন্দ-যাত্রা।”

“হৃদয়ের এই অন্তরঙ্গতা যত গভীর হবে ততই আমরা ঈশ্বরের অনুগ্রহ আমাদের জীবনে দেখতে পাবো। শত বাধাবিঘ্ন এবং অন্ধকারময় পরিস্থিতিতেও আমরা স্থির থাকতে পারবো”, বলেন আর্চবিশপ সুব্রত হাওলাদার ।
আর্চবিশপ সুব্রত হাওলাদার মেষপালকের ভূমিকা সম্পর্কে পোপ ফ্রান্সিসের কথা উল্লেখ করে বলেন, “উওম মেষপালক জনতার সামনে, মধ্যে ও পিছনে থেকে সর্বদায় তার মেষদের দেখাশুনা করেন।”
“যারা ঈশ্বরকে ভালবাসে ঈশ্বর সব কাজেই তাদেরকে সহায়তা দান করেন”, বলেন আর্চবিশপ হাওলাদার।
পবিত্র খ্রিস্টযাগের পরে শুরু হয় পবিত্র সাক্রামেন্তের আরাধনা, নিরাময় ও পুনর্মিলন অনুষ্ঠান। এরপর দিয়াং এর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রোজারি মালা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে তীর্থযাত্রীরা আলোক শোভাযাত্রা করেন।
তীর্থের মহাখ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন বরিশাল কাথলিক ডাইয়সিসের বিশপ ইম্মানূয়েল কানন রোজারিও। সবাইকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন,“এই দিনে আমরা এমন একজন মানুষের ভালোবাসার কথা স্মরণ করি যিনি সকল ভালোবাসার পথে নিয়ে যান। তিনি হলেন যিশুর মা মারিয়া। তাই আমরা মা মারিয়া সাথে আনন্দে পথে চলি।”

“দিয়াং মা মারিয়ার তীর্থের সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব উপলক্ষ্যে এই তীর্থোৎসবে মায়ের মধ্যস্থতায় আমাদের সকল কৃতজ্ঞতা, অনুগ্রহ প্রাপ্তির সকল ধন্যবাদ প্রভুর চরণতলে নিবেদন করি। আমাদের সকল আশা প্রত্যাশাগুলো যেন পূরণ হয় ও জীবনের পথ-যাত্রা আনন্দের সাথেই যেন সম্পন্ন হয়। আর মা-মারিয়ার সাথে এক মন এক প্রাণ হয়ে এই প্রার্থনা পুত্র ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করি”, বলেন বিশপ ইম্মানূয়েল রোজারিও ।
এই সময় তীর্থযাত্রীবন্দ ভক্তিপূর্ণ সময় অতিবাহিত করে ও বিশ্ব শান্তি ও মানব জাতির কল্যানের জন্য প্রার্থনা করেন।
তীর্থে যোগদানকারী একজন মারীয়া ভক্ত তার জীবন সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, “আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় আট বছর পার হয়ে গিয়েছে কিন্তু আমাদের কোন সন্তান হয়নি। আমি ও আমার স্বামী দিয়াং এর মা মারিয়ার নিকট গভীর বিশ্বাস ও ভক্তি নিয়ে প্রার্থনা করি এবং গত বছর আমরা একটা ছেলে সন্তান লাভ করি। তাই আজ আমরা এখানে এসেছি মা মারিয়াকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে।”
উল্লেখ্য, ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামে পর্তুগিজ বণিকদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববঙ্গে খ্রিষ্টবিশ্বাসেরও আগমন ঘটে। ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পর্তুগিজ বণিকেরা চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। এরপর ১৫৯৮ সালে দক্ষিণ ভারতের কোচিন থেকে বাংলায় প্রথম মিশনারিরা আসেন।
প্রথম মিশনারি জেজুইট ধর্মসংঘের পুরোহিত ফাদার ফ্রান্সেসকো ফার্নান্দেজ দিয়াং পূর্ববঙ্গের প্রথম গির্জা নির্মাণ করেন ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পাথরঘাটা বান্ডেল রোড ও জামালখানে দুটি গির্জা নির্মাণ করেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ১৯৭৬ সালের বড়দিনের পূর্বদিন চট্টগ্রাম জেলার দিয়াং-এ মরিয়ম আশ্রম চালু হয়। কিন্তু এ চিন্তাধারাটির সূত্রপাত হয় বিশ বছর পূর্বে যখন দিয়াং অনাথাশ্রমের কয়েকজন ছেলে ফাদার ফিলিপ পায়াকে তাদের 'গুরু হিসেবে নিয়ে একটি আশ্রম খোলার আশা পোষণ করে। কিন্তু ফাদার পায়া ভারতে বদলী হয়ে যান এবং মাদুরাই জেলার পালানিতে একটি আশ্রম খুলেন।
পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালের শেষার্ধে দিয়াং স্কুল ও অন্যান্য প্রকল্পসমূহ আশ্রম খোলার বাস্তবায়নের জন্য সক্রিয়ভাবে চিন্তা করতে থাকে। ব্রাদার ফ্লাভিয়ান লাপ্লান্তে সি,এস,সি স্বদেশে (ক্যানাডায়) ছুটি কাটিয়ে দিয়াং-এ ফিরে এসে পাহাড়ের মধ্যে নিজের বাসস্থানসহ একটি প্রার্থনা-কেন্দ্র স্থাপন করেন। এ প্রার্থনা-কেন্দ্রে ঈশ্বরের উপাসনা করার জন্য জনগণকে আহ্বান জানানো হয়।
পরে ১৯৪৫ সালে অনাথাশ্রমের গোড়া পত্তন থেকেই ধন্যা কুমারী মারিয়ার প্রতি ভক্তির নিদর্শন চলে আসছে। এর ফলস্বরূপ লুর্দের রাণী ধন্যা কুমারী মারিয়ার একটি 'গ্রটো' বা গুহা দিয়াং-এ নির্মাণ করা হয়েছে।
খ্রীষ্টান-অখ্রীষ্টান সবার কাছেই ধন্যা মারীয়ার বিশেষ আবেদন আছে। সবাই এখানে এসে ঈশ্বর ও মারিয়ার প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করতে পারেন। - আরভিএ সংবাদ