২০২৪ সালের বিশ্ব প্রেরণ-দিবস উপলক্ষ্যে মহামান্য পোপ ফ্রান্সিসের বাণী

প্রিয় ভাই ও বোনেরা,

এই বছরের বিশ্ব বাণীপ্রচার দিবস উপলক্ষ্যে আমি মঙ্গলসমাচারে উল্লেখিত বিবাহ ভোজের উপমা কাহিনীটিকে (মথি ২২:১-১৪) বিষয়বস্তু হিসাবে বেছে নিয়েছি। অতিথিরা তাঁর আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করার পর, রাজা, গল্পের মূল চরিত্র, তাঁর দাসদের বললেন, 'তোমরা এখন যাও, প্রতিটি রাস্তার মুখে গিয়ে সামনে যাদেরই দেখতে পাও, বিয়ের উৎসবে আসার জন্য তাদেরই নিমন্ত্রণ জানিয়ে ডেকে আন!' (মথি ২২,৯)। যীশুর আপন জীবনের প্রেক্ষাপট এবং উপমা কাহিনীর এই মূল অংশটি অনুধ্যান করে আমরা সুসমাচার প্রচারের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেখতে পাই। খ্রীষ্টের মিশনারী শিষ্য হিসাবে এটি আমাদের সকলের জন্য সময়োপযোগী, বিশেষভাবে সহযাত্রার (synodal journey) এই চূড়ান্ত পর্যায়ে। সহযাত্রার আদর্শ নীতিবাক্য হল- "সংযোগ, অংশগ্রহণ, মিশন", যার দ্বারা মণ্ডলীকে তার প্রাথমিক কাজে পুনরায় অভিনিবেশ করতে বা মনোযোগ দিতে বলা হয়, যা কিনা হল আজকের জগতে সুসমাচার প্রচার করা। "যাও এবং আমন্ত্রণ জানাও"। মিশন হল অক্লান্ত ভাবে অন্যদের কাছে গিয়ে তাদের সকলকে প্রভুর ভোজ সভায় আমন্ত্রণ জানানো। দাসদের কাছে রাজার যে নির্দেশ ছিল, তাতে আমরা দু'টি শব্দ খুঁজে পাই যা মিশনের অন্তঃকরণ: ক্রিয়াপদ দু'টি হল 'বাইরে যাওয়া' ও 'আমন্ত্রণ করা'। প্রথম শব্দটির ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, দাসেরা এর আগেও গিয়েছিল অতিথিদের রাজার আমন্ত্রণ জানাতে (৩-৪)। আমরা দেখি, অক্লান্ত ভাবে প্রতিটি পুরুষ ও নারীর কাছে গিয়ে তাদের ঈশ্বরের মুখোমুখি হতে ও তাঁর সঙ্গে সংযোগ তৈরী করতে আমন্ত্রণ জানানোই হল মিশন। অক্লান্ত! ঈশ্বর হলেন ভালবাসায় মহান এবং করুণায় সমৃদ্ধ। তিনি ক্রমাগত ভাবে প্রতিটি নর-নারীর মুখোমুখি হতে এবং ঐশরাজ্যের সুখ লাভ করতে আহ্বান জানান, এমন কি তাদের উদাসীনতা ও প্রত্যাখান সত্বেও। যীশুখ্রীষ্ট, উত্তম মেষপালক এবং ঈশ্বরের বার্তাবাহক নিজেই ইস্রায়েল জাতির মধ্যে হারানো মেষদের খুঁজে বের করতে বেরিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল হারানো মেষ যত দূরেই যাক্ না, তাদের খুঁজে বের করে ফিরিয়ে আনা (যোহন ১০:১৬)। তাঁর পুনরুত্থানের আগে ও পরে তিনি তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন "যাও"। আর এইভাবেই তিনি শিষ্যদের তাঁর আপন মিশন-কাজে সামিল করেছিলেন (লুক ১০:৩; মার্ক ১৬:১৬)। মণ্ডলী তার তরফে প্রভুর কাছ থেকে প্রাপ্ত মিশনের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত অবধি চলতে থাকবে, কখনো ক্লান্ত না হয়ে, অসুবিধা বা বাধায় হতদ্যম না হয়ে বার বার যাত্রা করতে থাকবে। আমি এই সুযোগে ধন্যবাদ জানাতে চাই সেই অসংখ্য বাণীপ্রচারকদের, যারা সবকিছু পেছনে ফেলে, আপন মাতৃভূমি ছেড়ে সুদূর দেশে যেখানে এখনো মঙ্গলবার্তা পৌঁছায় নি, তাদের কাছে সুসমাচার প্রচার করছেন কিংবা যারা সবেমাত্র তা গ্রহণ করেছে।

প্রিয় বন্ধুরা, মিশনের প্রতি আপনাদের উদার আত্মনিবেদন আপনাদের অঙ্গীকারের বাস্তব অভিব্যক্তি, যা যীশু তাঁর শিষ্যদের অর্পণ করেছিলেন "যাও, সমস্ত জাতির মানুষদের আমার শিষ্য কর; পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার নামে তাদের দীক্ষাস্নাত কর!" (মথি ২৮:১৯)। পৃথিবীর শেষ প্রান্ত অবধি বাণীপ্রচারের কাজের জন্য নতুন ও অসংখ্য বাণীপ্রচারকেরা যেন আহ্বান পায়, তারজন্য আমরা অনবরত প্রার্থনা করব এবং ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাব। আমরা যেন ভুলে না যাই, এই বিশ্বজনীন মিশনে অংশগ্রহণ করতে প্রতিটি খ্রীষ্টভক্ত আহত হয়েছে তার আপন জীবনে প্রতিটি প্রসঙ্গে মঙ্গলবার্তার সাক্ষ্য দিতে যাতে সমগ্র খ্রীষ্টমণ্ডলী তার প্রভুর সঙ্গে আজকের জগতের প্রতিটি রাস্তার 'চৌমাথায়' অবিরাম ভাবে এগিয়ে চলে। আজ মণ্ডলীতে যে অভিনয় চলেছে তা হল এই রকম, যীশু ভিতর থেকে দরজায় আঘাত করে চলেছেন যাতে আমরা তাঁকে বের হতে দিই! প্রায়শই মণ্ডলী নিজেকে 'অবরুদ্ধ' করে রাখে, ফলে প্রভুকে বাইরে বেরুতে দেয় না, তাঁকে 'নিজের করে' রাখে, অথচ প্রভু এসেছিলেন বাণীপ্রচার করতে আর তিনি চান আমরা তাঁর সেই বাণীর প্রচারক হই। দীক্ষাপ্রাপ্ত আমরা সকলে, আমাদের জীবনাবস্থা যা-ই হোক না কেন, যেন প্রস্তুত থাকি আবার নতুন ক'রে মিশনারী আন্দোলন শুরু করার জন্য, যেমনটি খ্রীষ্টধর্মের উষাকালে ঘটেছিল! ফিরে আসি উপমা-কাহিনীর রাজার আদেশের কথায়। দাসদের শুধু 'যাও' বলা হয়নি, সেই সঙ্গে 'আমন্ত্রণ'করতেও বলা হয়েছিল: "আপনারা আসুন, বিয়ের উৎসবে যোগ দিন!" (মথি ২২:৪)। এখানে আমরা ঈশ্বর প্রদত্ত মিশনের আরও একটি দিক দেখতে পাই যা কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা কল্পনা  করতে পারি, দাসেরা রাজার আমন্ত্রণ জরুরী ভিত্তিতে জানিয়েছিল, কিন্তু অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সহৃদয়তার সঙ্গে। ঠিক একই ভাবে যিনি কোন মানুষের কাছে মঙ্গলসমাচার প্রচার করছেন, তাকে অবশ্যই একই শৈলী অনুকরণ করতে হবে। সমগ্র বিশ্বের কাছে "ঈশ্বরের পরিত্রাণ সাধনকারী ভালবাসার সৌন্দর্য্য, যা যীশুখ্রীষ্টের মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে তা ঘোষণা করতে হবে" ((Evangelii Gaudium, 36) বাণীপ্রচারক শিষ্যেরা তা করবেন আনন্দের সঙ্গে, উদারতার সঙ্গে ও বদান্যতার সঙ্গে যা হল তাদের অন্তরে থাকা পবিত্র আত্মার দান করা ফসল" (গালাতীয় ৫:২২)। চাপ দিয়ে নয়, জোর করে নয়, ধর্মান্তরিত করে নয় বরং ঘনিষ্ঠতা, সমবেদনা ও কোমলতার সঙ্গে এবং এইভাবেই ঈশ্বরের আপন অস্তিত্ব ও কর্মপন্থা প্রতিফলিত করে।

২। "বিবাহ-ভোজ”: খ্রীষ্ট ও খ্রীষ্টমণ্ডলীর মিশনের খ্রীষ্টপ্রসাদীয় ও অন্তিম কালের ছবি। উপমা-কাহিনীতে রাজা তার চাকরদের পাঠান তার পুত্রের বিবাহ উৎসবের ভোজসভায় সবাইকে আমন্ত্রণ জানাতে। সেই ভোজসভা হল অন্তিকালের ভোজসভার পূর্বছবি। এটি ঈশ্বরের রাজ্যে চূড়ান্ত পরিত্রাণের একটি প্রতিচ্ছবি, যা এখনও পরিপূর্ণ হয় মশীহ এবং ঈশ্বরপুত্র যীশুর আগমনের ফলে, যিনি আমাদের প্রচুর পরিমাণে জীবন দান করেছেন (যোহন ১০:১০), প্রতীকী ভাবে দেখানো হয়েছে সুস্বাদু ও উপাদেয় খাদ্য ও উত্তম দ্রাক্ষারসে টেবিল সাজানোর মধ্য দিয়ে, যখন ঈশ্বর মৃত্যুকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন চিরকালের মতো (ইসাইয়া ২৫:৮)। খ্রীষ্টের মিশন সময়ের পূর্ণতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, যেমনটি তিনি তাঁর বাণীপ্রচারের শুরুতেই ঘোষণা করেছিলেন: সময় হয়ে এসেছে, ঐশ রাজ্য এখন খুব কাছেই" (মার্ক ১:১৫)। খ্রীষ্টের শিষ্যদের, তাদের প্রভু ও গুরুর এই মিশন-কর্মটি চালিয়ে যাওয়ার জন্য ডাকা হয়েছে। এখানে আমরা অন্তিমদিন অবধি মণ্ডলীর মিশনারী চরিত্রের বিস্তার বিষয়ে দ্বিতীয় ভাটিকান মহাধর্মসভার শিক্ষার কথা স্মরণে আনতে পারি: "সুতরাং খ্রীষ্ট প্রভুর প্রথম ও দ্বিতীয় আগমনের মাঝের সময়টুকুই হল প্রেরণকার্যের সময়, কারণ প্রভুর আসার আগে সকল জাতির কাছে মঙ্গলসমাচার প্রচারিত হতেই হবে" (মার্ক ১৩:১০; মণ্ডলীর প্রেরণকার্য বিষয়ক নির্দেশনামা ৯)।

আমরা জানি যে, প্রথম খ্রীষ্টানদের মধ্যে মিশনারী উদ্যমের একটি শক্তিশালী অন্তিমকালীন প্রতিচ্ছবির দিক ছিল। তারা মঙ্গলসমাচার প্রচারের আশু প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। আজও সেই একই দৃষ্টিভঙ্গী বজায় রাখা খুবই দরকার, কারণ তা আমাদের সাহায্য করবে আনন্দের সঙ্গে সুসমাচার প্রচার করতে যারা জানে যে "প্রভু তাদের কাছেই আছেন" এবং যারা লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে এই আশা নিয়ে যে একদিন আমরা সকলে ঐশরাজ্যে খ্রীষ্টের বিবাহ-ভোজে সামিল হব। বিশ্ব যখন আমাদের সামনে উপভোক্তাবাদ, স্বার্থপর আরাম, সম্পদের সঞ্চয়, ব্যক্তিবাদের বিভিন্ন "ভোজের" উপস্থাপনা করে, তখন সুসমাচার সকলকে আহ্বান করে "ঐশ্বরিক ভোজেসভায়" যোগদান করতে, যা আনন্দ, সহভাগিতা, ন্যায়বিচার এবং ঈশ্বর ও ভাই মানুষের সঙ্গে মিলন দ্বারা চিহ্নিত করে।

জীবনের এই পূর্ণতা যা খ্রীষ্টের দান, তার পূর্বাভাষ আমরা এখনই পাই যখন আমরা "তাঁর স্মরণে", তাঁরই আদেশে খ্রীষ্টযজ্ঞ সম্পাদন করি। সুসমাচার প্রচার কালে আমরা যে অন্তিমকালীন ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানাই, তা সহজাত ভাবে খ্রীষ্টযজ্ঞে আমন্ত্রণ জানানোর সঙ্গে সম্পৃক্ত, যেখানে প্রভু আমাদের তাঁর বাণী ও তাঁর দেহ-রক্ত দ্বারা ভোজন করান। পোপ ষোড়শ বেনেদিক যেমনটি আমাদের শিখিয়েছেন: "প্রতিটি খ্রীষ্টযজ্ঞের সম্পাদনে সংস্কারীয় ভাবে ঈশ্বরের জনগণের অন্তিম ভোজসভায় যোগদান সম্পন্ন করা হয়। আমাদের জন্য খ্রীষ্টযাগ হল সেই অন্তিম ভোজের পূর্ব-আস্বাদন, যেমনটি প্রবক্তারা বলে গেছেন (ইসাইয়া ২৫:৬-৯) এবং নবসন্ধিতে "মেষশাবকের বিবাহ-ভোজে" সামিল হওয়ার বর্ণনা করা হয়েছে (প্রত্যাদেশ ১৯:৯), যা সাধুসন্তদের আনন্দের সঙ্গে উদ্যাপন করা হবে (Sacramentum Caritatis, 31)

ফলস্বরূপ, আমরা সকলেই আহত হয়েছি খ্রীষ্টযাগের সমস্ত দিক এবং বিশেষ ভাবে এর অন্তিমকালীন ও মিশন-কর্মের দিক আমরা যেন আরো তীব্র ভাবে অনুভব করি। এই প্রসঙ্গে আমি পুনরুক্তি করতে চাই যে, "মিশনের প্রতি আকৃষ্ট না হলে আমরা নিজে থেকে খ্রীষ্টপ্রসাদীয় ভোজের টেবিলে যেতে পারি না, যা ঈশ্বরের আপন হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়ে সকল মানুষের কাছে পৌঁছানো বোঝায়"। কোভিড পরবর্তী সময়ে অনেক স্থানীয় মণ্ডলীতে জোরদার ভাবে খ্রীষ্টপ্রসাদীয়

পুনর্নবীকরণে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে যা প্রতিটি খ্রীষ্টভক্তের অন্তরে মিশনারী উদ্যম জাগাতে অপরিহার্য্য। প্রতিটি খ্রীষ্টযাগে কত না গভীর বিশ্বাস ও আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের উচ্চারণ করা উচিৎঃ "হে প্রভু আমরা তোমার মৃত্যুর কথা প্রচার করি, তোমার পুনরুত্থানের মঙ্গলবার্তা ঘোষণা করি, তোমার পুনরাগমনের প্রতীক্ষায় জেগে থাকি"!

২০২৫ সালের জুবলী বর্ষ উদ্যাপনের প্রস্তুতির উদ্দেশ্যে এই বছরটি প্রার্থনার জন্য উৎসর্গীকৃত করা হয়েছে, আমি সকলকে উৎসাহিত করতে চাই, সকলে যেন তাদের দীক্ষাকালীন অঙ্গীকার আরো মজবুত ক'রে তোলে, সর্বোপরি সকলে যেন প্রতিদিনের খ্রীষ্টযাগে অংশগ্রহণ করে এবং খ্রীষ্টমণ্ডলীর বাণীপ্রচার মিশন-কাজের জন্য প্রার্থনা করে। মুক্তিদাতার আদেশ অনুসারে খ্রীষ্টমণ্ডলী প্রতিটি খ্রীষ্টযাগে এবং মাণ্ডলিক উপাসানায় "প্রভুর প্রার্থনা"-র এই আবেদন "তোমার রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হোক" বলতে কখনোই ক্ষান্ত না হন। এই ভাবে প্রতিদিনের প্রার্থনা, বিশেষভাবে খ্রীষ্টযাগ আমাদের করে তোলে আশা ও মিশন কাজের তীর্থযাত্রী, শাশ্বত জীবন লাভের আশায় ঈশ্বর অভিমুখে চলা এবং তাঁর আয়োজিত ভোজসভায় যোগদান করার যাত্রী, যে ভোজসভা তিনি তাঁর সকল সন্তানদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন।

৩। "প্রত্যেকে": মণ্ডলীতে খ্রীষ্টশিষ্যদের সর্বজনীন মিশন পুরোপুরি ধর্মসভা সম্বন্ধীয় (Synodality) ও মিশনারী তৃতীয় এবং শেষ বিবেচনা হল রাজার আমন্ত্রণ গ্রহীতার বিষয় নিয়ে। "প্রত্যেকে" যেমনটি আমি জোর দিয়ে বলেছি, "এটি হল মিশনের অন্তঃস্থল বা হৃদয় কথাটি 'প্রত্যেকে', কাউকে বাদ দিয়ে নয়। তাহলে, আমাদের প্রতিটি মিশন যা খ্রীষ্টের হৃদয় থেকে উৎসারিত, যেন তিনি সকলকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করতে পারেন" (পোপের মিশনারী সংস্থার সাধারণ সভায় ভাষণ ৩রা জুন ২০২৩)। সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্বে বিভাজিত আজকের এই পৃথিবীতে প্রত্যেকের কাছে খ্রীষ্টের সুসমাচার কোমল কিন্তু দৃঢ় একটি আহ্বান যা আমাদের পরস্পরের মুখোমুখি হতে, পরস্পরকে ভাইবোন হিসাবে চিনতে এবং বিভেদের মাঝেও মিলনের আনন্দে মেতে ওঠার ডাক দেয়। "আমাদের ত্রাণকর্তা ঈশ্বর তো এই চান যে, সকল মানুষ যেন পরিত্রাণ লাভ করে, সকলেই যেন সত্যকে চিনে নিতে পারে" (১ তিমথি ২:৪)। সুতরাং আমরা যেন কখনোই ভুলে না যাই যে আমাদের প্রতিটি মিশনারী কাজকর্মের সময় প্রত্যেকের কাছে সুসমাচার প্রচার করতে বলা হয়েছে। নতুন কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করে নয় বরং আমাদের যেতে হবে এমন মানুষ হয়ে যারা তাদের আনন্দ ভাগ করে নিতে চায়, দিগন্তের সৌন্দর্য্য নির্দেশ করে এবং যারা অতিশয় সুস্বাদু ভোজের উৎসবে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানায় (Evangelii Gaudium, 14).

খ্রীষ্টের বাণীপ্রচারক শিষ্যদের সর্বদা সকল মানুষের জন্য হৃদয়-স্পর্শকারী গভীর অনুভূতি ছিল, তা তার সামাজিক অবস্থা, এমন কি নৈতিক অবস্থান যা-ই হোক না কেন। বিবাহ-ভোজের উপমা কাহিনীটি আমাদের বলে দেয় যে রাজার আদেশে "চাকরেরা তাই রাস্তায়-রাস্তায় গিয়ে ভাল-মন্দ যেমন লোককেই সামনে পেল, তাদের সকলকেই জড় করে নিয়ে এ ল" (মথি ২২:১০)। তারচেয়েও বড় কথা, 'যত গরিব, পঙ্গু, অন্ধ আর খোঁড়া লোককেই এখানে নিয়ে এসো!' (লুক ১৪:২১), এক কথায়, তুচ্ছতম ভাই ও বোনেরা, যারা সমাজেরই দ্বারা সমাজের শেষপ্রান্তে স্থান পেয়েছে, তারা সকলেই রাজার বিশেষ অতিথি। ঈশ্বর তাঁর পুত্রের বিবাহ উৎসবে যে ভোজের প্রস্তুত করেছেন তা সর্বদাই সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে, যেহেতু তাঁর ভালবাসা অপরিসীম ও শর্তহীন। " ঈশ্বর জগৎকে এতই ভালবেসেছেন যে, তাঁর একমাত্র পুত্রকে তিনি দান ক'রে দিয়েছেন, যাতে, যারা তাঁকে বিশ্বাস করে, তাদের কার-ও যেন বিনাশ না হয়, বরং তারা সকলেই যেন লাভ করে শাশ্বত জীবন" (যোহন ৩:১৬)। প্রত্যেকে, প্রতিটি পুরুষ ও প্রতিটি মহিলা ঈশ্বরের অনুগ্রহে অংশগ্রহণ করতে আমন্ত্রিত, যে অনুগ্রহ রূপান্তরিত করে ও পরিত্রাণ করে। একজনকে শুধু 'হ্যাঁ' বলতে হবে বিনামূল্যে প্রাপ্ত এই ঐশ্বরি দান পাওয়ার জন্য, এই দান গ্রহণ করতে হবে, এর দ্বারা নিজেকে রূপান্তরিত হতে দিতে হবে, এই দানকে "বিয়ের পোষাক"-এর (দ্রষ্টব্য: মথি ২২:১২) মতো পরতে হবে।

সর্বজনীন মিশনের জন্য প্রয়োজন সকলের অঙ্গীকার। সুসমাচার প্রচারকাজে আমাদের সম্পূর্ণ ধর্মসভা-সম্বন্ধীয (Synodality) ও মিশনারী মণ্ডলী হয়ে ওঠার লক্ষ্যে ক্রমাগত যাত্রা চালিয়ে যেতে হবে। সিনোডালিটি অর্থাৎ সহযাত্রা মূলতঃ মিশনারী, উল্টো ভাবে মিশন সর্বদাই সহযাত্রা। অতএব, বিশ্বমণ্ডলী ও স্থানীয় মণ্ডলীর ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ মিশনারী সহযোগিতা আজ আরো জরুরী ও প্রয়োজনীয়। দ্বিতীয় ভাটিকান ধর্মমহাসভা ও আমার পূর্বসূরীদের পদাঙ্ক অনুসরণ ক'রে আমি সারা বিশ্বের সকল ধর্মপ্রদেশের কাছে পোপের মিশন সংস্থার পরিষেবার সুপারিশ করছি। তারা প্রাথমিক উপায়গুলির প্রতিনিধিত্ব করে, "যার মাধ্যমে কাথলিকগণ শিশু অবস্থা থেকে একটি সত্যিকার সার্বজনীন ও মিশনারী দৃষ্টিভঙ্গীসহ অনুপ্রাণিত হয়। আর এ সব হল সমগ্র মিশন-ক্ষেত্রের জন্য নিজ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী তহবিল সংগ্রহের কার্যকরী উপায়" (Ad Gentes, 38 = খ্রীষ্টমণ্ডলীর প্রেরণকার্য বিষয়ক নির্দেশনামা, ৩৮)। সেই কারণে বিশ্ব প্রেরণ দিবসে সমস্ত স্থানীয় মণ্ডলীতে সংগৃহীত চাঁদা বিশ্ব-সহভাগিতার তহবিলে দেওয়া হয় যেন সেখান থেকে পোপের 'বিশ্বাস বিস্তার সংস্থা' পোপের নামে মণ্ডলীগুলির মিশন-কাজের জন্য তা বণ্টন করতে পারে। আসুন, আমরা প্রভুর কাছে প্রার্থনা জানাই, তিনি যেন আমাদের পরিচালনা করেন, আমাদের আরো সিনোডাল ও মিশনারী মণ্ডলী হয়ে উঠতে সাহায্য করেন (বিশপ সম্মিলনীর সাধারণ সভার সমাপ্তিকালীন খ্রীষ্টযাগের উপদেশ, ২৯শে অক্টোবর ২০২০)।

পরিশেষে, মা মারীয়ার দিকে চোখ তোলা যাক, যিনি গালিলেয়ার কানা নগরে যীশুকে তাঁর প্রথম অলৌকিক কাজ সম্পন্ন করতে বলেছিলেন (যোহন ২:১-১২)। প্রভু সেদিন নববিবাহিত দম্পতি ও আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য প্রচুর পরিমানে নতুন দ্রাক্ষারস সরবরাহ করেছিলেন। এটি ছিল, কালের শেষে ঈশ্বর সকলের জন্য যে বিবাহ-ভোজের প্রস্তুত করছেন তারই পূর্বাভাষ। আসুন, আমাদের এই যুগে খ্রীষ্টশিষ্যদের বাণীপ্রচার কাজের জন্য তাঁর মাতৃসুলভ মধ্যস্থতা কামনা করি। আমাদের মায়ের আনন্দ ও ভালবাসার সম্পর্ক, তাঁর কোমলতা ও স্নেহ থেকে উৎপন্ন শক্তির সঙ্গে (cf. Evangelii Gaudium, 288) আসুন আমরা এগিয়ে যাই রাজার, আমাদের পরিত্রাতার আমন্ত্রণ সকলের কাছে পৌঁছে দিতে। বাণীপ্রচারকদের ধ্রুবতারা মা মারীয়া, আমাদের জন্য প্রার্থনা কর।

পোপ ফ্রান্সিস, রোম - অনুবাদ ফাদার তিমির সিংহ এসজে এবং দিলীপ গোমেজ