কলকাতার ক্রাইস্ট দ্য কিং গির্জায় আন্তর্মান্ডলীক আলোচনা সভা
বিগত ৫ই ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ, কলকাতার পার্কসার্কাসে ক্রাইস্ট দ্য কিং গির্জায় বিকাল সাড়ে তিনটায় একটি একুমেনিক্যাল বা আন্তর্মান্ডলীক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
ইংরেজিতে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভাটির শিরোনাম ছিল Ecumenical Panel Discussion on "Pilgrims of Hope." একুমেনিজম শব্দটি বিভিন্ন খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলির মধ্যে আন্তর্মান্ডলীক সহযোগিতাকে বোঝায় যাতে একই খ্রিস্টে বিশ্বাস করে তাদের মধ্যে পূর্ণ ঐক্য স্থাপন করা যায়। এই উদ্দেশ্যে প্রতি বছর জানুয়ারীতে সারা বিশ্বের খ্রিস্টভক্তরা প্রার্থনার সপ্তাহ পালন করে।
এই সভায় বিশিষ্ট বক্তারা ছিলেন:
১. বিশপ সালভাডোর লোবো - বারুইপুর ক্যাথলিক ধর্ম প্রদেশের প্রাক্তন বিশপ
২. ফাদার ব্যাপটিস্ট পায়াস এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি, সিসিবিআই-এর আন্তর্মান্ডলীক সহযোগিতা কমিশন
৩.বিশপস কলেজ কলকাতার অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ডক্টর সুনীল মাইকেল ক্যালেব (সিএনআই)
৪. ডাঃ সুভাশিষ চট্টোপাধ্যায় - বাইবেল থিওলজির বিশারদ (ধর্মারাম কলেজ), এবং ইংরেজির অধ্যাপক নরসিংহ দত্ত কলেজ হাওড়া (কলকাতা ইউনিভার্সিটি)
৫. ডাঃ ডোরা অপর্ণা মন্ডল, প্রাক্তন অধ্যক্ষা – উইমেন্স কলেজ কলকাতা
৬. রেভারেন্ড ডাঃ ফ্রান্সিস পুভেলিল - মর্নিং স্টার কলেজ ব্যারাকপুরের রিজিওনাল সেমিনারী
৭. ফাদার সাজু জর্জ এস.জে – পেশাদার ভারতনাট্যম নৃত্যশিল্পী এবং কালহৃদয় গুরুকুলের (বাকেশ্বর, নেপালগঞ্জ, কলকাতা) প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক।
প্রতি বক্তাকে ১০ মিনিট সময় দেওয়া হয়, যদিও আলোচনার গুরুত্বের জন্য সময়সীমা ছাড়িয়ে যায়।
আলোচনা সভার প্রথম বক্তা ফাদার ব্যাপটিস্ট বলেন যে “বর্তমানে আমাদের শান্তির বড়ই অভাব। রোজই আমরা নানারকম সমস্যা, বেকারত্ব, ধর্মীয় মেরুকরণ এবং ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মুখোমুখি হচ্ছি। কিন্তু আমাদের জীবনে শান্তিই সবচেয়ে বড় কথা এবং তা বিরাজ করে যখন জীবনে স্বাধীনতা, খোলামেলা আলোচনার পরিসর, নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া, পরস্পরকে ক্ষমা, পুনর্মিলন এবং সম্প্রীতির আবহ থাকে। যিশু এসেছিলেন আমাদের এই শান্তি দিতে। এই শান্তি আবারও আসবে যখন সমস্ত খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলি একে অপরের সাথে একত্রিত হবে।“
কনফারেন্স অফ ক্যাথলিক বিশপস্ অফ ইন্ডিয়া (CCBI) এই কঠিন সময়েও মন্ডলীকে আরও ভালভাবে বপন করার জন্য এবং সেইসঙ্গে প্রাণের প্রাচুর্য দেওয়ার জন্য একটি পালকীয় পরিকল্পণা করেছে যার নামকরণ হয়েছে মিশন-২০৩৩। এই প্রক্রিয়া চলমান রাখার জন্য প্রতিটি ধর্ম প্রদেশে, ধর্মপল্লীগুলিতে এবং স্থানীয় গির্জার স্তরে একুমেনিক্যাল কর্মসূচি তৈরি করা হয়েছে যার মধ্যে থাকবে বাইবেল পাঠ/আলোচনা, আমাদের প্রভাবিত করে এমন সামাজিক সমস্যাগুলির উপর আলোচনা, এবং সব গীর্জাগুলির মধ্যে যোগাযোগের জন্য সিসিবিআই (CCBI)-এর স্পষ্ট নির্দেশিকা।
বিশপ সালভাডোর লোবো
তিনি জুবিলী ২০২৫-এর থিম দিয়ে শুরু করে বলেন যে “`আশার তীর্থযাত্রী' হল আমাদের স্বর্গে পৌঁছানোর মিশন। আশা হল ভবিষ্যতের ভালর উপরে বিশ্বাস, যা চোখে দেখা যায় না। আশা হল মন্দের উপর ভালোর চূড়ান্ত জয়ের বিশ্বাস। আশা হল ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।“
একুমেনিজমের উপর বিশপ লোবো তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন “বহু বছর আগে একজন যুবক পুরোহিত হিসাবে বাসন্তী যাওয়ার পথে এক রাতে তিনি ক্যানিং রেলওয়ে স্টেশনে আটকে পড়েছিলেন এবং মশার কামড় এবং অজানা লোকের মধ্যে প্ল্যাটফর্মে ঘুমানোর ব্যবস্থা করছিলেন। তাঁর দুর্দশার কথা শুনে একজন হিন্দু দোকানদার তাঁকে তাঁর বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটাতে নিয়ে যান। সেই বন্ধু একজন সিএনআই যাজক ছিলেন। তিনি তাঁর ভাল যত্ন নেন, এমনকি পরের দিন সকালে তাঁকে স্টেশনেও পৌঁছে দেন। বিশপ লোবোর মতে এই ঘটনাটি ছিল একুমেনিজমের প্রকৃ্ষ্ট উদাহরণ। এই অভিজ্ঞতাই ভবিষ্যতে তাঁকে সিএনআই এবং অন্যান্য চার্চের সাথে একযোগে, বারুইপুর ডায়োসিসের উন্নয়নের জন্য অনেক প্রকল্পে কাজ করতে সহায়তা করে। বিশপ বলেন আমরা তখনই ভালো কাজ করতে এবং ভালোভাবে বাঁচতে পারব যখন আমরা 'আশার তীর্থযাত্রী' থিমটি আত্মস্থ করব।“
রেভারেন্ড ডক্টর সুনীল ক্যালেব হলেন অর্থনৈতিক নীতি ও উন্নয়ন, বিশেষ করে দলিতদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর একজন বিশারদ। জুবিলি-২০২৫ এবং এর থিমের উপর বলার সময় তিনি উল্লেখ করেন যে “১৩০০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই ক্যাথলিক মন্ডলী জুবিলি বা জয়ন্তী বছর উদযাপন করছে, যা প্রতি ৫০ বছর অন্তর করা হয়। জয়ন্তী বছরে সব কিছু প্রভু ঈশ্বরকে অর্পণ করা, ঋণ ক্ষমা করা, দাসদের মুক্তি দেওয়া, এবং বাজেয়াপ্ত করা সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।“
ভারতীয় অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে তিনি উল্লেখ করেন যে “দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সাধারণ মানুষের ক্ষতির অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষকদের অনেক ঋণের বোঝা, জিনিসের আকাশ ছোঁয়া দাম, তীব্র বেকারত্ব, ধনী-দরিদ্রের আয়ের বৈষম্য মানুষের জীবন দুরহ করে তুলেছে। এগুলি থেকে মনযোগ সরিয়ে দেওয়ার জন্য ধর্মীয় মেরুকরণ করা হচ্ছে।“
তিনি বলেন, “মন্ডলী বিষয়-আশয় দিয়ে বিশ্বাসীদের কষ্ট লাঘবের কোনও আশা দিতে পারবে না। মন্ডলী বড় জোর আমাদের দৈনন্দিন সংগ্রামে ঈশ্বরের আমাদের সঙ্গে থাকার আশা দিতে পারবে।“
ডাঃ শ্রীমতি ডোরা অপর্ণা মন্ডল বলেন যে উইমেন্স কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষা এবং এসসিএম (স্টুডেন্টস খ্রিস্টান মুভমেন্ট) এর প্রাক্তন যুব সেক্রেটারি থাকার কারণে, একুমেনিজম নিয়ে তাঁর প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে। তিনি জানান যে এই ক্ষেত্রে বারুইপুর ডায়োসিসে বিশপ সালভাডোর লোবোর সাথে অনেক প্রকল্পে কাজ করেছেন।
একজন সাধারণ খিস্টভক্তের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেন:
১. যদিও আন্তর্মান্ডলীক ঐক্য প্রচেষ্টার নেতৃবৃন্দগণ সমস্ত খ্রিস্টানদের মধ্যে আধ্যাত্মিক মিলন বা একতা দাবি করেন, ক্যাথলিক মন্ডলী অ-ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের পবিত্র ক্রিস্টপ্রসাদ গ্রহণ করতে দেয় না।
২. ক্যাথলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি অন্যান্য খ্রিস্টানদের ভর্তি নেওয়ায় খুব অনীহা দেখায়। কিন্তু তারা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্যাথলিকদের ভর্তি নেয় ঠিক যেমন তিনি অনেক ক্যাথলিক মেয়েদের তাঁর কলেজে ভর্তি নিয়েছেন। এই বৈষম্য থাকলে আন্তর্মান্ডলীক ঐক্য প্রচেষ্টা থমকে যেতে পারে।
৩. আন্তর্মান্ডলীক ঐক্য প্রচেষ্টায় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের আয়ের বিষয়টিতে প্রায় একেবারই নজর দেওয়া হয় না। এতে যুব সম্প্রদায় মন্ডলী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
৪. একুমেনিজম এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপ চালানোর জন্য আমরা কি আমাদের নিজস্ব ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ ছেড়ে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের কাছে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছি?
অধ্যাপক ডাঃ সুভাশিষ চট্টোপাধ্যায় প্যানেল আলোচনায় তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে নেওয়ার জন্য তিনি ফাদার সুনীল রোজারিওকে এবং অন্যান্য বক্তাদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, যদিও তিনি একজন কট্টর কালীভক্ত, তিনি গ্যালিলির যিশুকে অকুন্ঠ ধন্যবাদ জানাবেন, কারণ তাঁর ইচ্ছা ছাড়া, তিনি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য উপস্থিত হতে পারতেন না।
ফাদার ফ্রান্সিস বলেন যে ঈশ্বরের রাজ্য পৃথিবীতে নয় আমাদের হৃদয়ে রয়েছে। তিনি বলেন ভ্যাটিকান কাউন্সিল-২ হল বিশ্বের প্রথম একুমেনিক্যাল কাউন্সিল। `আশার তীর্থযাত্রী’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে ঈশ্বর আমাদের জীবনযাত্রার প্রতিটি ধাপে আমাদের সাথে চলেন এবং সবসময় আমাদের সহায়তা করবেন, ঠিক যেমন মরুভূমিতে তিনি ইস্রায়েলীয়দের ৪০ বছর ধরে প্রতিদিন সকালে মান্না এবং পাথর থেকে জল জুগিয়েছিলেন।
ফাদার সাজু জর্জ এসজে শান্তি ও ঐক্যের সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাপী আন্তর্মান্ডলীক ঐক্য প্রচেষ্টার উপর তাঁর বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন যে তিনি গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যর মাধ্যমেই তিনি সারা বিশ্বের মানুষের কাছে যীশুর সুসমাচার পৌঁছে দিতে পারছেন। জুবিলি ২০২৫-এর থিম `আশার তীর্থযাত্রী’ সম্বন্ধে তিনি বলেন যে একমাত্র আশাই আমাদের শত প্রতিকূলতার মধ্যে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, যেমন একুমেনিজম এবং আন্তঃধর্মীয় আলাপ-আলোচনা হতাশার মধ্যে তাঁকে আশা দেখিয়েছে। উদাহরণস্বরুপ তিনি বলেন তাঁর জেসুয়িট সম্প্রদায়ের বাইরে অনেকে তাঁকে নানা ভাবে সাহায্য করেছেন, বিশেষ করে তাঁর নৃত্য কেন্দ্র কলাহৃদয় চালানোর জন্য তহবিলের গুরুতর সংকটের সময়ে, যেখানে তিনি অত্যন্ত দরিদ্র ও দলিত সম্প্রদায়ের ৩৫০-এরও বেশি ছাত্র-ছাত্রীদের নিখরচায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য শেখান। তিনি অকপটে বলেন যে তাঁর পৃষ্ঠপোষকদের ৯০% হল লুথেরান, প্রেসবিটেরিয়ান এবং সারা বিশ্বের অ-ক্যাথলিক গীর্জা ও খ্রিস্টভক্তরা।
সমগ্র অনুষ্ঠানটির উদ্যোক্তা ছিলেন ডিরেক্টর ফর একুমেনিজম এবং ক্রাইস্ট দ্য কিং গির্জার পালপুরোহিত ফাদার বেসিল বি. মান্ডি। ফাদার সুনীল রোজারিও, একুমেনিজমের আঞ্চলিক সম্পাদক আলোচনাটির সুষ্ঠু পরিচালনা করেন।
প্রতিবেদক: আইজাক হ্যারল্ড গোমস