কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ পার্লারে অনুষ্ঠিত হলো প্রয়াত শ্রী বিজয় কুমার সিংহের স্মরণানুষ্ঠান
বিগত ২০ নভেম্বর ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ পার্লার হলে অনুষ্ঠিত হলো প্রয়াত শ্রী বিজয় কুমার সিংহের স্মরণানুষ্ঠান। যিনি ছিলেন বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র সংগীত বিভাগের অধ্যাপক, খ্রীষ্টধর্ম প্রচারক, নাট্যকার, অভিনেতা, রবীন্দ্র ও খ্রীষ্ট সঙ্গীত শিল্পী ও শিক্ষক।
তাঁর স্মরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বারুইপুর ধর্মপ্রদেশের মাননীয় বিশপ শ্যামল বোস মহোদয়, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রিন্সিপাল ফাদার ডমিনিক সাভিও এসজে., রেক্টর ফাদার জয়রাজ ভেল্লুস্বামী, ভাইস প্রভিনসিয়াল ফাদার সানি এসজে. , অন্যান্য ফাদারগণ, সেন্ট মেরিস কনভেন্ট এর ডিএসএ সিস্টারগণ এবং কলকাতা ও কলকাতা সংলগ্ন বিভিন্ন ধর্মপল্লীর ভক্তগণ।
সমগ্র অনুষ্ঠানটির আয়োজনে ছিলেন বাংলা হেরাল্ড এর সম্পাদক ফাদার তিমির সিংহ এস.জে. এবং ব্রাদার চিন্তামনি এস.জে.।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই তাঁর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন বিশপ শ্যামল বোস সহ অন্যান্য ফাদার, সিস্টার এবং সাধারণ ভক্তগণ। এরপর ফাদার সানি তাঁর ছবি আশীর্বাদ করেন।
বিশপ মহোদয় প্রয়াত শ্রী বিজয় সিংহের শোকার্ত পরিবার ও আগত সকলের উদ্দেশ্যে বলেন যে “আমাদের প্রত্যেকের জীবনের কঠিন সত্য হলো ‘মৃত্যু’। এই মৃত্যু কখন, কিভাবে, কার কাছে আসে তা কেউ বলতে পারে না। এই মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা একদিন ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছিলাম এবং মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আবার তাঁর কাছে ফিরে যাব।“
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বিশপ মহোদয় আরও বলেন যে “কলকাতায় যখন পোপ দ্বিতীয় জন পল এসেছিলেন তখন আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বিজয়দার কাছে থেকে গান শেখার যা আজও ভোলার নয়। তিনি রবীন্দ্র সংগীতের পবিত্রতা ও সারমর্মকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন পন্ডিত সঙ্গীতজ্ঞ এবং সেভাবেই তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন সকলের কাছে।“
ফাদার তিমির বলেন যে “গানের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর সেবা করা এবং ভাই মানুষদের সেবা করাই ছিল দাদার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। “
উল্লেখ্য স্বর্গীয় বিজয় কুমার সিংহের জন্ম ৭ মে ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দ এবং মৃত্যু ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ । তিনি অবিভক্ত ২৪ পরগণা জেলার সুন্দরবন অঞ্চলের এক প্রত্যন্ত গ্রাম বাসন্তীতে জন্ম গ্রহণ করেন। বাবা নিকোলাস সিংহ ছিলেন বাংলা খ্রীষ্টীয় সঙ্গীতের অন্যতম পথিকৃৎ। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন খ্রীষ্ট ধর্মপ্রচারক, নাট্যকার, অভিনেতা, সঙ্গীত শিল্পী ও শিক্ষক। ছোট থেকেই বাবার সৃজনশীলতার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল তাঁর উপর।
কলকাতার জেসুইট ফাদারদের সহায়তায় বাসন্তীতে স্কুল শিক্ষা শেষ করে তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বাণিজ্য শাখায় স্নাতক হন। এরপর শান্তিনিকেতন আশ্রমের সঙ্গীত ভবনে ভর্তি হন। নজরে পড়েন অধ্যক্ষ শ্রী শান্তিদেব ঘোষ মহাশয়ের এবং ছাত্রাবাসে থেকে স্বচ্ছন্দে পড়াশোনা চালিয়ে যাবার জন্য পান সরকারী বৃত্তি। এখান থেকে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেন।এর কিছুদিন পর বিজয় সিংহ নিযুক্ত হন বিশ্বভারতীর পাঠভবনের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে।
স্বর্গীয় বিজয় সিংহ মহাশয় কলকাতার সেন্ট মেরিস্ এন্টালী কনভেন্ট, প্রভু যীশুর গির্জা, রাঘবপুর গির্জা, কেওরা পুকুর গির্জা, বাঁশদ্রোনী গির্জা, বাসন্তী গির্জা, ব্যারাকপুর এর ধ্যান আশ্রম, ব্যান্ডেল গির্জায় একসময় নিয়মিত গির্জার গানগুলি শেখাতে যেতেন। বোলপুরের বিশ্বভারতীর কাছেই মাদার তেরেসাকে বলে, সেখানে " শান্তিদান "প্রতিষ্ঠার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
শান্তিনিকেতনে খ্রিস্টীয় পরিসর তৈরীর প্রধান কান্ডারী ছিলেন তিনি। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আজ সেখানে মকরমপুর ইনফ্যান্ট জেসাস চার্চ তৈরি হয়েছে। তারপাশেই ভাগলপুর সিটিসি সিস্টারদের – সেন্ট তেরেসাস স্কুল ও ওনার সহায়তায় গড়ে ওঠে। রতনপল্লীতে জেসুইট সমাজের একটি কেন্দ্র ‘পরশমণি ‘ স্থাপিত হয়েছে।
১৯৮৬ সালে ৪ ঠা ফেবরুয়ারি পোপ দ্বিতীয় জন পলের কলকাতা সফরের সময় খৃষ্টযাগের গানের অন্যতম পরিচালনা ও প্রার্থনার সুরগুলি বিজয় সিংহের করা ।
মাদার তেরেসার তিরোধান দিবসে "আছে দুঃখ" গানটি গেয়ে সেই অনুষ্ঠানে মাদারের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছিলেন, যেটা মাদার তাঁকে এইদিনের জন্যে গাইতে বলে গিয়েছিলেন। খ্রিস্টীয় সংগীতের বিশিষ্ট গীতিকার ও সুরকার মানিক নাথের প্রায় সমস্ত গানগুলির স্বরলিপিকার ছিলেন বিজয় সিংহ।
বিজয় বাবুর সঙ্গেই স্ত্রী কাজল সিংহও পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন সমাজসেবায় নিয়োজিত করেন নিজেকে। কন্যা সূনৃতা সিংহ দত্ত বর্তমানে শান্তিনিকেতনে নৃত্য পরিবেশন, পরিচালনা ও শিক্ষকতা করেন। সূনৃতার ভাবনাতেই ২০০৬ সালে পিতা ও কন্যা মিলে শুরু করেন “ভৈরবী” গান ,নাচ ও ছবি আঁকার প্রতিষ্ঠান, বর্তমানে ভৈরবীর প্রধান কর্ণধার হিসাবে সূনৃতা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাবার স্বপ্ন।
অন্যদিকে পুত্র সৈকত কুমার সিংহ মূলতঃ রবীন্দ্রসঙ্গীত, খৃষ্টীয় সঙ্গীত চর্চা, বাউল-লোকগীতি ও স্বতন্ত্র সঙ্গীত পরিবেশন ও রবীন্দ্রনৃত্য পরিবেশন ছাড়াও সঙ্গীত পরিচালক ও আবহ সংগীতকার হিসাবে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপনের কাজে নিযুক্ত রয়েছেন।
বিজয় কুমার সিংহ শুধু চেয়েছিলেন গুরুদেবের গান যেন সঠিক ভাবে ছাত্র-ছাত্রীরা শিখতে পারে, সঠিক ভাবে গাইতে পারে। দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা তাঁর অগণিত ছাত্র-ছাত্রীর শুদ্ধ রবীন্দ্রসংগীত সাধনার মধ্যেই তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন।
প্রতিবেদন –তেরেসা রোজারিও
ব্যক্তিগত তথ্য সৌজন্যে - সুমন কুমার সিংহ, সৈকত কুমার সিংহ