পোপ ফ্রান্সিস: বিনয়, করুণা ও সেবার এক যাত্রা

পোপ ফ্রান্সিস

পুরো নাম: জর্জ মারিও বার্গোগলিও  

জন্ম তারিখ: ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৬ 

জন্মস্থান: বুয়েনোস আইরেস, আর্জেন্টিনা 

পোপত্বকাল: ১৩ মার্চ, ২০১৩ – ২১ এপ্রিল, ২০২৫ 

পোপীয় মন্ত্রণালয়: Miserando atque eligendo (“করুণা প্রদর্শন করে এবং তাঁকে নির্বাচন করে”)

---

প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা:

বুয়েনোস আইরেসে জন্মগ্রহণ করেন হোর্হে মারিও বেরগোলিও, যিনি ইতালীয় অভিবাসী পরিবারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ। যাজকত্বে প্রবেশের আগে তিনি রসায়নে ডিপ্লোমা অর্জন করেন এবং একটি রাসায়নিক পরীক্ষাগারে টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন, এমনকি নাইটক্লাব বাউন্সার হিসেবেও কাজ করেন। 

তবে গভীর  ধর্মবিশ্বাস তাঁকে ১৯৫৮ সালে যীশু সংঘে (জেসুইট) যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করে, যেখানে তিনি মানবিক বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর তিনি জেসুইট পুরোহিত হিসেবে অভিষিক্ত হন।

---

ধর্মীয় কর্মজীবন:

ফাদার বেরগোলিও অল্প সময়েই একজন বিনয়ী  পুরোহিত অথচ প্রভাবশালী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি আর্জেন্টিনায় যীশু সংঘের প্রাদেশিক প্রধান নিযুক্ত হন এবং সামরিক শাসনের সময় গির্জার নেতৃত্ব দেন। 

সহজ জীবনযাপনের জন্য পরিচিত, তিনি প্রায়শই সাধারণ পরিবহন ব্যবহার করতেন এবং সাদাসিধে বাসস্থানে থাকতেন। 

পোপ জন পল দ্বিতীয় ১৯৯২ সালে তাঁকে বুয়েনোস আইরেসের সহকারী বিশপ এবং ১৯৯৮ সালে আর্চবিশপ নিযুক্ত করেন। আর্চবিশপ হিসেবে তিনি সামাজিক ন্যায়বিচার, গরিব ও প্রান্তিক মানুষের অধিকারের পক্ষে কাজ করেন। 

২০০১ সালে তিনি কার্ডিনাল পদে উন্নীত হন এবং খ্রীষ্টমণ্ডলীর বিশ্বব্যাপী কার্যক্রমে তাঁর প্রভাব আরও বৃদ্ধি পায়।

--- পোপ পদে অধিষ্ঠান: একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন

২০১৩ সালের ১৩ মার্চ, কার্ডিনাল বেরগোলিও রোমান ক্যাথলিক খ্রীষ্টমণ্ডলীর ২৬৬তম পোপ হিসেবে নির্বাচিত হন এবং তিনি “ফ্রান্সিস” নাম গ্রহণ করেন— যা সেন্ট ফ্রান্সিস অফ আসিসির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন।

এই নির্বাচন অনেক কারণে ইতিহাসে বিশেষ স্থান পেয়েছে:

১. *আমেরিকা মহাদেশ থেকে প্রথম পোপ* – পোপ ফ্রান্সিস হলেন আমেরিকা (আর্জেন্টিনা) এবং দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে নির্বাচিত প্রথম পোপ। 

২. *প্রথম জেসুইট পোপ* – তিনি যীশু সংঘের (জেসুইট) সদস্য হিসেবে নির্বাচিত প্রথম পোপ। 

৩. *প্রথম ফ্রান্সিস নামধারী পোপ* – এর আগে কোনো পোপ এই নাম গ্রহণ করেননি। 

৪. *একটি বিরল পদত্যাগের পরে নির্বাচন* – প্রায় ৬০০ বছর পর পোপ বেনেডিক্ট ষোড়শ-এর পদত্যাগের পরে এই নির্বাচন হয়, যা ঘটনাটিকে আরও ঐতিহাসিক করে তোলে। 

৫. *একটি নতুন পাস্তোরাল পন্থা* – তাঁর নেতৃত্ব করুণা, অন্তর্ভুক্তি ও সংস্কারের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত, যা পোপত্বে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করে।

এই সব কারণেই অনেক ঐতিহাসিক ও বিশ্লেষক তাঁর নির্বাচনকে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে বিবেচনা করেন।

---

মূল থিম ও অবদানসমূহ

পোপ ফ্রান্সিস তাঁর সাধারণ জীবনধারার জন্য পরিচিত, যেমন তিনি অপূর্ব রাজপ্রাসাদের পরিবর্তে ভ্যাটিকানের অতিথি গৃহে বসবাস করেন এবং দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের সেবার ওপর জোর দেন। 

 – তিনি গরিব, শরণার্থী ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন এবং বিশ্ব নেতাদের প্রতি মানবিক দুর্ভোগ কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

পরিবেশের যত্ন** – ২০১৫ সালে প্রকাশিত তাঁর এনসাইক্লিকাল "লাউদাতো সি’" জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে দ্রুত

পদক্ষেপের আহ্বান জানায় এবং “আমাদের সাধারণ বাড়ি” রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে। 

তিনি ইসলাম, ইহুদিধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও অন্যান্য খ্রিস্টান গোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং শান্তি ও ঐক্যের বার্তা ছড়িয়েছেন। 

তিনি “একটি শ্রবণ যোগ্য  খ্রীষ্টমণ্ডলী” গড়ে তুলতে চান, যেখানে প্রান্তিক সম্প্রদায়ের পাস্তোরাল চাহিদা এবং মণ্ডলীর নেতৃত্বে বৃহত্তর অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আলোচনা করা যায়।

---

তাঁর নির্বাচিত লেখনিসমূহ

 ইভানজেলিগাউদিউম(Evangelii Gaudium) (সুসংবাদের আনন্দ) – ২০১৩ 

"লাউদাতো সি" Laudato Si’ (আমাদের সাধারণ ঘরের যত্ন নিয়ে) – ২০১৫ 

আমোরিস লাটেসিয়া(Amoris Laetitia)(ভালোবাসার আনন্দ) – ২০১৬ 

ফ্রাটেলি টুট্টি(Fratelli Tutti) (ভ্রাতৃত্ব ও সামাজিক বন্ধুত্ব নিয়ে) – ২০২০

---

উত্তরাধিকার ও প্রভাব

পোপ ফ্রান্সিস করুণা, অন্তর্ভুক্তি ও সেবার বার্তার মাধ্যমে ক্যাথলিক মণ্ডলীকে রূপান্তরিত করে চলেছেন। 

তাঁর বিখ্যাত উক্তি, “আমি কে বিচার করার?”— এই কথাই তাঁর সহানুভূতিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য মানসিকতার পরিচয় বহন করে। 

তাঁর পোপত্ব চিহ্নিত হয় গরিবদের প্রতি ভালোবাসা, পৃথিবীর যত্ন এবং বিশ্বাস ও আশার মাধ্যমে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার এক নিরলস প্রচেষ্টা দ্বারা। 

এই কঠিন সময়েও তিনি বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য এক বিনয়, করুণা ও সেবার আলোকবর্তিকা হয়ে আছেন। অনুলিখন – চন্দনা রোজারিও।