কলকাতার ক্যাথিড্রাল অফ দ্যা মোস্ট হোলি রোজারি গির্জায় পোপ ফ্রান্সিস ঘোষিত জুবিলি ২০২৫ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন

জুবিলির পতাকা উত্তোলনের পরে আর্চবিশপ টমাস ডি'সুজা জুবিলি ক্রুশটি দু’হাতে উঁচুতে তুলে ধরে পবিত্র দরজা দিয়ে প্রবেশ করেন।

রবিবার ২৯ শে ডিসেম্বর ০২৪ খ্রিস্টাব্দে, সাধু যোসেফ-মারীয়ার পূণ্য পরিবারের পার্বনের দিনে, কলকাতার আর্চবিশপ টমাস ডি'সুজা মুরগিহাট্টার ক্যাথলিক ক্যাথিড্রালে (ক্যাথিড্রেল অফ দ্যা মোস্ট হোলি রোজারি গির্জায়/Cathedral of the Most Holy Rosary) জুবিলি ২০২৫ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।

স্মরণ করা যেতে পারে জুবিলি-২০২৫ এর ঘোষণা করার সময় পোপ ফ্রান্সিস নির্দেশিকা জারি করে জানিয়েছিলেন যে বিশ্বের প্রতিটি ক্যাথিড্রালে রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, বিশপরা একযোগে জয়ন্তী বছর পালনের গণ উদ্বোধন করবেন।

এই বিশেষ অনুষ্ঠানের শুরুতে আর্চবিশপ টমাস সমস্ত পুরোহিতবর্গ, সিস্টারগণ ও প্রতিটি ধর্মপল্লী থেকে আগত আমন্ত্রিত ভক্তমন্ডলীদের সাথে ক্যাথিড্রালের উঠান প্রদক্ষিণ করার পরে সাঁওতালি যুবতিরা তাঁদের প্রথা অনুযায়ী তাঁর হাত ধুয়ে দেয়। তার পরে তিনি জুবিলি বা খ্রিস্ট জয়ন্তী ২০২৫ এর পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকা উত্তোলনের সময় জয়ন্তী-২০২৫ এর থিম গানটি  বাংলায় গাওয়া হয়। গানটির শুরুর পংক্তি হলো:  "উজ্জ্বল শিখার মত আমার/প্রত্যাশা দীপ জ্বলছে। যেন ঊর্ধ্বে তোমার পানে/ আমার এ গান ধ্বনিছে।"

জুবিলির পতাকা উত্তোলনের পরে আর্চবিশপ জুবিলি ক্রুশটি দু’হাতে উঁচুতে  তুলে ধরে প্রার্থনা করেন এবং সাঁওতালি গান ও নাচের সাথে পবিত্র দরজা দিয়ে সমবেত ভক্তমন্ডলীর সঙ্গে ক্যাথিড্রালের ভিতরে যান। তিনি ক্রুশটিকে বেদীর কাছে দাঁড় করিয়ে রাখেন। এর পরে তিনি ব্যাপ্তিস্ম দেওয়ার জলাধারকে আশীর্বাদ করেন এবং ভক্তমন্ডলীর মাথায় সেই জলাধারের পবিত্র জল ছিটিয়ে দেন।

বাংলায় প্রথম (সিরাচ থেকে ৩:২-৬ এবং ১২-১৪) পাঠ এবং হিন্দিতে দ্বিতীয় পাঠের (কলসীয়দের কাছে সেন্ট পলের ৩:১২-২১ পত্র) পরে ডিকন বেসিল টিগ্গা পবিত্র বাইবেলটি মাথায় তুলে ধরেন এবং লুক ২:৪১-৫২ থেকে মঙ্গলসমাচার পাঠ করেন।

আর্চবিশপ টমাস তাঁর ধর্মোপদেশের শুরুতেই বলেন যে পোপ ফ্রান্সিস আমাদের আশার তীর্থযাত্রী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ও স্বর্গের অভিমুখে এই তীর্থযাত্রায় আমাদের দয়ালু ও সহানুভুতিশীল হয়ে, দুঃস্থদের আশার দেখাতে বলেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি জানান যে কলকাতা মহাধর্মপ্রদেশের চারটি গির্জাকে তীর্থস্থান হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে৷ এগুলি হল: (১) মুরগিহাট্টার ক্যাথিড্রাল (২) ব্যান্ডেল ব্যাসিলিকা, (৩) চার্চ অফ আওয়ার লেডি অফ লুর্ডস, বারাসাত এবং (৪) সেন্ট পল দ্য এপোস্টেল চার্চ, কামারচৌকি, পশ্চিম মেদিনীপুর। তিনি কলকাতা মহাধর্মপ্রদেশের খ্রিস্টভক্তদের এই চারটি গির্জা পরিদর্শন করে সেখানে জুবিলি বছরে বিশেষ প্রার্থনা করার অনুরোধ জানান। তিনি প্রত্যেকটি  পরিবারকে সাধু যোসেফ-মারীয়া-যিশুর পূণ্য পরিবারের ভালবাসা, আনন্দ, বিশ্বাস এবং একত্রে থাকার সহজ জীবনধারা অনুকরণ করার অনুপ্রেরিত করেন যাতে তাদের সন্তানরা যীশুর মতো জ্ঞান এবং শৃঙ্খলায় বেড়ে ওঠা শিখতে পারে।

পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক প্রভাব,  কোভিড-১৯ মহামারীর চলমান পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং জলবায়ু সংকটের হাত থেকে সুরাহার জন্য এই ২০২৫-এর যিশু জয়ন্তী সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি আশার বছর হবে। তিনি ধৈর্যকে "আশার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত একটি গুণ" হিসাবে বর্ণনা করেছেন, এবং লিখেছেন, "এই পবিত্র বছরের সময়, আমাদের ভাই ও বোনদের মধ্যে যারা নানারকম দুঃখ-কষ্ট ও হতাশায় ভুগছে, তাদের যেন আমরা আশার আলো দেখাতে পারি।"

"জয়ন্তী" হল মানুষের জীবনের প্রধান সাফল্যগুলি চিহ্নিত করে সেগুলির উদযাপন করা। যেমন এক রাজার দীর্ঘ জনসেবার উদযাপন। অথবা বিবাহ বার্ষিকীর উদযাপন। সাধারণত একটি জয়ন্তী প্রতি ২৫ বছর অন্তর পালন করা হয়। ২০২৫-এ যিশু জয়ন্তী হল সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের সাথে,  একে অপরের সাথে, বিশেষ ভাবে আমাদের প্রতিবেশী এবং পরিবেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক শুধরে নেওয়ার সময়। 

জয়ন্তী উদযাপনের ইতিহাস

প্রাচীন ইহুদিদের সমাজে জুবিলি বা জয়ন্তী বছরকে ইয়োবেলের বা "ছাগলের" বছর বলা হতো, কারণ ছাগলের শিং দিয়ে তৈরি বাদ্যযন্ত্র ফুঁ দিয়ে বাজিয়ে পার্বনের দিনটি পবিত্র বছর হিসাবে ঘোষণা করা হতো। প্রবক্তা মোশীর আইন অনুসারে জয়ন্তী বছরে দাসদের তাদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। এছাড়া, যে জমিগুলি বলপূর্বক দখল করা হয়েছিল, একমাত্র ঈশ্বরই সব জমির মালিক, এই বিশ্বাসে সেগুলি আসল মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়া হতো। সাধারণত প্রতি পঞ্চাশ বছরে জয়ন্তী উদযাপন করা হতো।

ক্যাথলিক গির্জা বা মন্ডলীতে, জয়ন্তী বা 'পবিত্র বছর' ঘোষণা করা হতো ক্ষমা এবং পুনর্মিলনের জন্য। ১৩০০ শতাব্দীর শুরু ঘোষণা করার জন্য সেই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি সাধু পিতরের পর্বের দিনে, পোপ অষ্টম বনিফেস প্রথমবার জয়ন্তী বছর ঘোষণা করেন। তিনি এইরকম 'পবিত্র বছর' প্রতি একশো বছরে উদযাপন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর পরে পোপ দ্বিতীয় পল ১৪৭০ সালে, প্রতি ২৫ বছর অন্তর জয়ন্তী বা 'পবিত্র বছর' পালনের নির্দেশনামা জারি করেন। তখন থেকেই মন্ডলী এই প্রথা মেনে চলছে।

জুবিলি-২০২৫ এর উদ্বোধনী খ্রিস্টযাগের শেষে থিম গানটি ইংরেজিতে গাওয়া হয়। সমগ্র অনুষ্ঠানে বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি তিনটি গায়কদলেরই সঙ্গীত খুবই মনোগ্রাহী হয়েছিল। শেষে আর্চবিশপ টমাস ঘোষণা করেন যে কলকাতা মহাধর্মপ্রদেশে ২৮ শে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত জুবিলি বা যিশু জয়ন্তী বছর চালু থাকবে।   

প্রতিবেদক:

আইজাক হ্যারল্ড গোমস