রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের নবাই বটতলা ধর্মপল্লীতে উদযাপিত হলো রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার তীর্থোৎসব
গত ১৬ জানুয়ারী ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের নবাই বটতলা ধর্মপল্লীতে উদযাপিত হলো রক্ষাকারিনী মা মারীয়ার তীর্থ উৎসব।
এই তীর্থোৎসবকে কেন্দ্র করে খ্রিস্টভক্তদের আধ্যাত্নিক প্রস্তুতি স্বরুপ নয় দিনের নভেনা প্রার্থনা, পবিত্র খ্রিস্টযাগ, পাপস্বীকার সংস্কার, ও মানত দানের মাধ্যমে বহুসংখ্যক মারীয়া ভক্ত বিশ্বাসী এই তীর্থোৎসব যোগদান করে।
এই তীর্থোৎসবের খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন বাংলাদেশের কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও, রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ জের্ভাস রোজারিও, রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ফাদার, ব্রাদার, সিস্টারসহ প্রায় বারো হাজার খ্রিস্টবিশ্বাসী উপস্থিত ছিলেন।
খ্রিস্টযাগের শুরুতে বিশপ জের্ভাস রোজারিও সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, “আমরা খুবই আনন্দিত কারণ স্বর্গীয়া মা যিনি আমাদের রক্ষাকারিণী তাঁর কাছে আমরা এসেছি তাঁকে ভক্তি-শ্রদ্ধা জানাবার জন্য এবং আমাদের সকল মানত তার কাছে উৎসর্গ করতে।”
পবিত্র খ্রিস্টযাগের উপদেশে কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’রোজারিও বলেন, “আমরা সবাই তীর্থযাত্রী। তীর্থযাত্রা করে আমরা এখানে এসেছি। কোন স্থান তখনই তীর্থ স্থান হয় যখন কোন পবিত্র কিছু ঘটিত হয়। ঈশ^রের দর্শনের কারণে, পবিত্র মানুষের কারণে তীর্থস্থান হয়। নবাই বটতলা তীর্থস্থান হয়েছে কারণে এখানে পবিত্র ঘটনা ঘটেছে। যে ঘটনা এক সময় ছিল একটি গ্রামের তা হয়ে উঠেছে ধর্মপ্রদেশের। আমরা যারা তীর্থযাত্রী হয়ে এসেছি আমাদের প্রত্যেকের পরিবারে খ্রিস্টবিশ্বাসের গঠন ও অনুশীলন জরুরী।”
রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার তীর্থে অংশগ্রহণ করে ধর্মপল্লীর প্রসঞ্জিত মারান্ডী বলেন, “আমি ছোট থেকেই রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার তীর্থোৎসবে অংশগ্রহণ করে আসছি। আমি অসুস্থ অবস্থায় মা’র কাছে প্রার্থনা করে সুস্থ হওয়ায় তাঁর প্রতি আমার বিশ্বাস জেগে উঠে। তাই প্রতিবছর এ তীর্থে এসে আমি আশীর্বাদ কামনা করি যেন সুন্দর ভাবে জীবন-যাপন করতে পারি।”
বোর্ণী ধর্মপল্লীর অরুনা স্বপ্নীল রোজারিও বলেন, “এ বছর তীর্থোৎসব যথেষ্ঠ ভক্তিপূর্ণ ও আধ্যাত্মিকময় ছিল। আমি রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার কাছে প্রার্থনা ও মানত করেছি, বিশ্বাস করি তিনি আমাকে সাহায্য করবেন ও আশীর্বাদ করবেন।”
নবাই বটতলা রক্ষাকারিণী মা-মারীয়ার তীর্থস্থান একটি সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রাম। তবে এই গ্রামে কিছু সংখ্যক উড়াও পরিবারও রয়েছে। এই তীর্থস্থানটি বরেদ্রের তীর্থস্থান নামেও বেশ পরিচিত। এই গ্রামের সকলেই খ্রীষ্টান এবং প্রায় ৩০০টি’র বেশী খ্রিস্টিয় পরিবার রয়েছে।
নবাই বটতলা রক্ষাকারিণী মা-মারীয়ার তীর্থস্থানটি রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের একটি অন্যতম তীর্থস্থান যেখানে খ্রিস্টান, হিন্দু, মুসলিম সকলেই তীর্থ করতে আসে। ২০১৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই জানুয়ারী নবাই বটতলাকে কোয়াজি ধর্মপল্লী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এই তীর্থস্থানটি হবার পিছনে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের একটি বাস্তব ঘটনা। ৭১’র এর যুদ্ধের ভয়াবহতার সময়ে, গ্রামবাসীরা মা-মারীয়ার কাছে সমবেতভাবে প্রার্থনা করে সকলে বিপদের হাত থেকে আশ্চর্যজনকভাবে রক্ষা পেয়েছিল।
আর ঘটনাটি ছিল এই রকম, নবাই বটতলা গ্রামটি পাক সেনারা পুরো ঘিরে ফেলে, এবং বিভিন্ন বাড়ীর জিনিসপত্র লুটপাট করে ও গ্রামের যুবকদেরসহ (অন্যান্যদের) হত্যার জন্য এগিয়ে নিয়ে আনেন। এমতাবস্থায় গ্রামের গীর্জা মাস্টার লুইস মুরমু এবং লক্ষণ ভিক্টর হাঁসদা ঘন্টা বাজিয়ে গ্রামের সবাইকে তখনকার মাটির গীর্জা ঘরে সমবেত হয়ে মা-মারীয়ার নিকট প্রার্থনা করার আহবান জানান, যেন মা-মারীয়া এই বিপদের হাত থেকে গ্রামসহ সকল মানুষকে রক্ষা করেন।
কি ভয়াবহ এক কান্ড, পাক সেনারা গ্রামে প্রবেশ করেন এবং ছোট-বড় সবাইকে লাইন করে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন। সবাইকে যখন হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়ার জন্য উদ্যত হন এর ঠিক পূর্ব মুহুর্তেই একটি বাঁশির হুইসেল বাজিয়ে দেন একজন পাক মেজর। আর তাদের নির্দেশনায় ছিল বাঁশির হুইসেল বাজার সাথে সাথেই অবস্থান পরিবর্তন করে চলে যেতে হবে।
ফলে গুলি ছোড়া থেকে পাক-সেনারা বিরত থাকেন। তবে গ্রামের অনেকেই তখন সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, খুব সম্ভবত মেজরটি ছিলেন একজন খ্রীষ্টান। পরে পাক সেনারা গ্রামের কয়েকটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে চলে যান।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় গ্রামের একটি বাড়িও আগুনে পুড়েনি এবং কোনরূপ ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। গ্রামের ভক্ত বিশ্বাসী মানুষ প্রাণ ভরে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানায় মা-মারীয়াকে। মা-মারীয়ার কৃপা আর্শীবাদের জন্য গ্রামবাসী সমবেতভাবে সিদ্ধান্ত নেন মারীয়াকে ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতার জানানোর জন্য একটি পর্ব উদযাপনের।
তাদের সেই চিন্তামতে, ১৯৭২ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি মা-মারীয়ার নামে ধন্যবাদ কৃতজ্ঞতার পর্ব উৎসব উদযাপন করেন। তবে দিনদিন এই পর্বের কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বর্তমানে নবাই বটতলা ‘রক্ষাকারিনী মা-মারীয়া’র নামে তীথোৎসব উদযাপন করা হচ্ছে।
২০০৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের তখনকার বিশপ পৌলিনুস কস্তা পর্বীয় খ্রীষ্টযাগে নবাই বটতলাকে ‘রক্ষাকারিনী মা-মারীয়াকে’ তীর্থস্থান হিসেবে ঘোষণা দেন।
এই তীর্থস্থানটির সৌন্দর্য বধর্নে ২০১৯ খ্রীষ্টাব্দে, নতুন ভাবে মা-মারীয়ার গ্রটো নির্মান ও ক্রুশের পথের ১৪টি স্থানের অনুধ্যানের দৃশ্য, মূর্তি স্থাপন এবং খ্রীষ্টযাগের বেদীও নির্মাণ করা হয়।
নবাই বটতলা রক্ষাকারিণী মা মারীয়ার তীর্থোৎসব বাংলাদেশ মণ্ডলীর জন্য একটি আশীর্বাদ। ভক্তের প্রার্থনা ও বিশ্বাসের ফলে এ উৎসব দিনে দিনে আরো বিস্তার লাভ করছে। - সংবাদ সংগ্রহে: পিটার ডেভিড পালমা