মেক্সিকোর আদিবাসীদের অধিকার-রক্ষার মহান শহিদ ফাদার মার্সেলো পেরেজ এস. জে.
গত ২০ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ, দক্ষিণ মেক্সিকোর চিয়াপাস প্রদেশে জেজুইট ফাদার মার্সেলো পেরেজকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
মেক্সিকোর যিশুসংঘ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, মেক্সিকোর দক্ষিণে অবস্থিত কুক্সকিতালি শহরে সকাল ৭টায় রবিবাসরীয় খ্রিষ্টযাগ উৎসর্গ শেষে তাঁর কর্মস্থল সাধু ক্রিস্টাবেল দে লাস কাসাস শহরের গুদালুপ প্যারিসে নিজের গাড়িতে করে ফিরছিলেন।
পথে সকাল নয়টার দিকে দুজন বন্দকধারী মোটরবাইক আরোহী তাঁর পথ অবরোধ করে। খুব কাছে থেকে তাঁকে ৮বার গুলি করে। গুলিতে তিনি তাঁর গাড়িতেই মৃত্যুবরণ করেন।
মেক্সিকোর জেজুইট প্রভিন্সিয়াল ফাদার লুইস জেরার্দো এস. জে. বলেছেন, “ফাদার মার্সেলো পেরেজকে হত্যা করে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে স্তিমিত করা যাবে না। আমরা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানাই।”
“আমরা অঙ্গীকার করছি ফাদার মার্সেলো পেরেজের কাজ আরও দৃঢ় পদক্ষেপে চালিয়ে যাব। তিনি এইযুগের স্বাক্ষ্যমর। তিনি আমাদের আদর্শ”, বলেন ফাদার লুইস।
এদিকে মেক্সিকোর কাথলিক বিশপ কনফারেন্স ফাদার মার্সেলো পেরেজকে “যিশুর একনিষ্ঠ শিষ্য ও নিপীড়িত জনগণের মুক্তির দিশারী” বলে উল্লেখ করেছেন।
এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরকার বাহিনীর মদত আছে বলে অনেকেই দাবি করেন। কেননা ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জুলাই আরও ২জন জেজুইট ফাদার জেভিয়ার ক্যাম্পোস এস. জে. ও জোয়াকিন সেজার এস. জে. আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।
সরকার সেই দায় না নিয়ে বরং সেই ঘটনাকে অনাকাঙ্খিত বলে উড়িয়ে দেন। অথচ ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে লোপেজ ওব্রাদোর ক্ষমতায় আসার পর থেকে আজ অবধি ৭জন ফাদার আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন।
ফাদার মার্সেলো পেরেজ এস. জে. ছিলেন বিখ্যাত মায়া-সভ্যতার উত্তরসূরি তোজ্জিল নামক আদিবাসী জনজাতির প্রতিভূ। তাঁর এই পারিবারিক ঐতিহ্য তাঁকে প্রতিবাদী ও সংগ্রামী করে তুলেছে।
যিশুসংঘে যোগদানের পরে তিনি যখন দেখতে পেলেন যে, তাঁর জনজাতির ওপর সরকার সমর্থিত সশস্ত্র জঙ্গিদলের আগ্রাসন বেড়েই চলেছে, তখন তিনি তাদের নিরাপত্তা দেবার স্বপ্নে বিভোর হন।
তাই ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে যিশুসংঘে যাজক হবার পর এই অঞ্চলে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষায় তিনি সোচ্ছার হন।
পরে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে সিমোজভেল প্যারিসে থাকতেই তিনি সশস্ত্র জঙ্গিদলের সমঝোতার কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠেন। তিনি মেক্সিকো ও গুয়াতেমালা সীমান্তের ১২টি শহরের মানুষের মধ্যে বিশাল এক তীর্থযাত্রার আয়োজন করে সেখানে সশস্ত্র জঙ্গিবাহিনীর সংগঠিত আক্রমণকে প্রতিহত করার আহবান জানান।
পরের বছর সরকার প্রাণসংশয়ের অজুহাতে তাঁর জন্য নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করেন। একই সরকার ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে ২২ জন মানুষ অপহরণের দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারিপরোয়ানা জারি করা হয়। আসলে সমস্ত ঘটনায় মেক্সিকো সরকারের পরোক্ষ প্রভাব আছে সেটা নিশ্চিত।
পরবতীর্তে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শান্তি-প্রতিষ্ঠার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন।
জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ৫০ বছর বয়সী ফাদার মার্সেলো পেরেজ এস. জে. ছিলেন একজন আপোষহীন সৈনিক। আদিবাসীদের পক্ষ নিয়ে সভা-সমিতি ও মিছিল করার জন্য ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের শুরু থেকেই তাঁকে বহুবার হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
তবুও তিনি ছিলেন অকুতোভয়। ইদানিং অবস্থা খারাপ হলে এবং ঘন ঘন প্রাণনাশের হুমকি এলে জেজুইট কর্তৃপক্ষ ফাদার মার্সেলো পেরেজকে কিছুদিন আগে তাঁর পূর্বের কর্মস্থল থেকে সরিয়ে সাধু ক্রিস্টাবেল প্যারিসে স্থানান্তরিত করেন।
এই বছর ২রা আগস্ট ফাদার পেরেজ তাঁকে হত্যার হুমকির কথা প্রকাশ করেন। এমনকি তাঁর মাথার মূল্য ৫৫ হাজার মার্কিন ডলার ঘোষণা করা হয় । এই হুমকির পর তাঁর মনোভাব ছিল: '“চারিদিকে অনেক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটছে। আমার উপরও আক্রমণের সম্ভাবনা আছে। তাই বলে শান্তি স্থাপনের প্রক্রিয়া ও প্রচেষ্টা বন্ধ করা ঠিক নয়। ঈশ্বরই আমার একান্ত ভরসা।”
ফাদারের প্রচেষ্টা ছিল সশস্ত্র অপরাধীদলের সঙ্গে স্থানীয় স্বেচ্ছা-প্রহরীদের মধ্যে বিরাজমান বিবাদ নিরসন করা। অপরাধীদলের দৌরাত্ম্যে অনেক নিরীহ মানুষ হতাহতের শিকার হয়েছ। বহু মানুষ প্রতিবাদ করে অপহৃত হয়েছে। সেই এলাকায় প্রায়শই দুইদলের মধ্যেকার বন্দুকযুদ্ধে মানুষ প্রাণ হারাত।
বিগত তিনমাসে এইভাবে প্রায় ৫০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। দুশ্চিন্তার বিষয় যে, গত ১৮ বছরে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে সরকার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে নানান সশস্ত্রগোষ্ঠী প্রায় ৫ লক্ষাধিক মানুষ নির্বিচারে হত্যা করেছে। তাদের মধ্যে ৫২ জন পুরোহিত।
ফাদার মার্সেলো পেরেজ এস. জে. ছিলেন আক্রান্ত মানুষের ভরসাস্থল। তিনি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তাদের মান-সম্মান ও অধিকার রক্ষার এক পরম আশ্রয় ছিলেন তিনি।
ফাদার মার্সেলো পেরেজ এস. জে. ছিলেন মানুষের সংগ্রামে সক্রিয় এক যিশুসঙ্গী যাজক। তিনি চারদেয়ালের মধ্যে থেকে বেরিয়ে নিপীড়িত মানুষের মধ্যে খ্রিষ্টকে অন্বেষণ করেছেন। তাদের সংগ্রামের সাথী হয়েছেন। তাদের সঙ্গে কষ্ট সহ্য করেছেন।
তিনি ধর্ম ও শাস্ত্রকে মানুষের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে গ্রহণ ও যাপন করেছেন। ফাদার মার্সেলো পেরেজ এস. জে.-র জীবন আমাদের অনুপ্রাণিত করুক । - ফাদার প্রদীপ পেরেজ এস. জে.