ভারতীয় মার্গসংগীতের বিষ্ণুপুর ঘরানার ওপর আজ আমাদের এই আলোচনা।

 

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মল্লভূম বিষ্ণুপুর, ইতিহাসের শহর, মন্দিরের শহর, টেরাকোটা শিল্পের শহর আর মার্গসংগীতের শহর। মার্গসংগীতের অর্থ সংগীতের খাঁটি শাস্ত্রীয় পদ্ধতি। এই  শহরকে ইউনেস্কো (UNESCO) ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট তকমা দিয়েছে।

 

এই শহরেই জন্ম নিয়েছে বাংলার এক ও একমাত্র নিজস্ব সঙ্গীত ঘরানা। গায়করা মূলত ধ্রুপদিয়া। তাঁরা ধ্রুপদ গেয়ে থাকেন। ‘ধ্রুপদ’ শব্দটি এসেছে ধ্রুবপদ শব্দ থেকে। ধ্রুব, অর্থাৎ শাশ্বত যে পদ, অর্থাৎ সংগীত। ধ্রুবপ্রবন্ধ বা প্রবন্ধগীতির ইতিহাস অতি প্রাচীন। মূলত আধ্যাত্মিক সংগীত, ঈশ্বরের বন্দনায় পদগুলি লেখা হত। পরে অবশ্য ঋতু বর্ণনা, রাজার প্রশস্তি এগুলিও ধ্রুপদের বাণীতে জায়গা করে নেয়।

 

বিষ্ণুপুরের ধারায় প্রবন্ধগীতির প্রচলন করেন আদিপুরুষ রামশঙ্কর ভট্টাচার্য। তিনি বৃন্দাবনে গুরুর কাছে মথুরা-বৃন্দাবন অঞ্চলে শ্রীকৃষ্ণের আরাধনায় প্রচলিত গায়কি শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। মল্ল রাজাদের আনুকূল্যে তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্যরা সে উত্তরাধিকার বহন করে নিয়ে যান। মল্ল রাজারা বৈষ্ণব ছিলেন। তাঁদের প্রতিষ্ঠিত দেবমন্দিরে ঈশ্বর সাধনায় নিবেদিত হয় বিষ্ণুপুরের ধ্রুপদ। এতে অলংকার কম, ভক্তিভাব বেশি। পশ্চিম ভারতীয় ধ্রুপদের ঐশ্বর্য আর আড়ম্বরের তুলনায় বিষ্ণুপুরের ধ্রুপদের শৈলী সাধারণী গুণসম্পন্ন, সংগীতের সরল ও অনাড়ম্বর রূপে ভাস্বর। রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন বাংলার নিজস্ব এই ধারায়।

 

বিষ্ণুপুরের নিবাসী রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের নাম পাওয়া যায় আদিগুরু হিসেবে। তারও আগে ছিল কীর্তনের চর্চা। আশ্চর্য নয় যে কীর্তনের সুর বিষ্ণুপুরের গায়কিতে প্রভাব ফেলেছে। রবীন্দ্রনাথের গানেও কীর্তনের প্রভাব সুস্পষ্ট। বিষ্ণুপুরে মার্গসঙ্গীতের চর্চা শুরু হয় রামশঙ্করের হাত ধরে, মোটামুটি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে। এখানে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন আসতে পারে, রামশঙ্করের শিক্ষাগুরু কে? কীর্তন থেকে সুরের নদীটি বয়ে গিয়ে ধ্রুপদকে কেমন করে আপন করে নিল?

কিছু দ্বিমত অবশ্য এই ক্ষেত্রে আছে। প্রচলিত ধারণা আছে সঙ্গীত সম্রাট তানসেনের বংশীয় এক গায়কের হাতে বিষ্ণুপুর ঘরানার সূত্রপাত। বিষ্ণুপুরে তাঁর নাম বাহাদুর খান বা বাহাদুর সেন। গবেষক শ্রী দিলীপ কুমার মুখোপাধ্যায় অবশ্য এই ধারণা সমর্থন করেন না। তাঁর মতে মথুরা - বৃন্দাবনের জনৈক 'পন্ডিতজি' ছিলেন রামশঙ্করের গুরু। পুরীধামে তীর্থযাত্রা সেরে ফেরার পথে তিনি বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজা  চৈতন্য সিংহের, সভায় কিছুকাল কাটান ও রামশঙ্করকে ধ্রুপদ শেখান।


বিষ্ণুপুর ঘরানার অন্যতম সংগীতগুণী সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও তানসেনের বংশধরের তত্ত্বটি সমর্থন করেননি। রামশঙ্কর ভট্টাচার্য দীর্ঘজীবনের অধিকারী ছিলেন। বিষ্ণুপুর শৈলীর ধ্রুপদের মূল সুরটি তিনিই বেঁধে দিয়েছিলেন। একঝাঁক প্রতিভাবান শিষ্য আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁর ধ্রুপদ গানে, শিষ্যত্ব বরণ করেছিলেন। পুত্র রামকেশব ভট্টাচার্য্য, অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, যদুনাথ ভট্টাচার্য্য (যদুভট্ট) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এই যদুভট্টই জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বালক রবীন্দ্রনাথকে গানের শিক্ষা প্রদান করেন।


যদুভট্টর পরের প্রজন্ম ছিলেন রাধিকা প্রসাদ গোস্বামী। একই সঙ্গে ছিলেন অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিন পুত্র - রামপ্রসন্ন, গোপেশ্বর ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁরা সবাই ছিলেন অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিষ্য। এনাদের উল্লেখযোগ্য শিষ্যরা হলেন জ্ঞানেন্দ্র প্রকাশ গোস্বামী (জ্ঞান গোঁসাই), রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এর মধ্যে বিষ্ণুপুর ঘরানার উজ্জ্বল প্রদীপটি বিষ্ণুপুরের বন্দ্যোপাধ্যায় বংশের হাতে স্থানান্তরিত হয়েছে। সেই প্রদীপ আজ সত্যকিঙ্কর – পুত্র, সঙ্গীতাচার্য অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কয়েক হাজার শিষ্য - প্রশিষ্যের কন্ঠে দীপ্তিমান। প্রতিবেদন – অতনু দাস।

Please Like, Comment & Share.

#rvapastoralcare #RVA_BengaliService #Banideepti #BRBC #RVA #Sangskriti #AtanuDas