বিশপ জের্ভাস রোজারিও’র তপস্যাকালীন বাণী

শ্রদ্ধেয় ও স্নেহের খ্রিস্টভক্তগণ ও ভাই বোনেরা,

সমগ্র জগত ও মানব মুক্তির জন্য যিশু খ্রিস্টের জীবনের প্রধান ঘটনাবলী: যাতনাভোগ, মৃত্যু ও পুনরুত্থান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এসব ঘটনাবলী সামনে রেখে মাতা মণ্ডলি তপস্যা তথা অনুতাপের মধ্য দিয়ে খ্রিস্টবিশ্বাসীদের আত্মশুদ্ধি ও মন পরিবর্তনের জন্য সাতটি সপ্তাহ নির্দিষ্ট করেছে। আর এই দীর্ঘ সময়টুকুতে মানব মুক্তি রহস্যের এই ঘটনাসমূহ অনুধ্যান করে আমরা অনুতাপ, প্রার্থনা, ত্যাগস্বীকার ও প্রায়শ্চিত্তের মধ্য দিয়ে নতুন মনের ও বিশ্বাসে নবায়িত মানুষ হয়ে ঈশ্বরের নিকট ফিরে আসি। একই সাথে সৎ কাজ, সৎ চিন্তা ও অভাবী-দুঃখী মানুষের পাশে থেকে পুণ্যের পথে চলতে শুরু করি।

মণ্ডলিতে নতুন মানুষ ও খাঁটি বিশ্বাসের মানুষ হয়ে ঈশ্বরের নিকট ফিরে আসার নির্দিষ্ট সময়টি ভস্ম বুধবারের উপাসনার মধ্য দিয়ে শুরু হয়। দেহে ছাই বা ভস্ম মেখে আমরা সকলেই স্বীকার করি যে, আমরা সকলে মানুষ হিসেবে স্বভাবগতভাবে খুবই দুর্বল ও পাপী। তাই পাপের ক্ষমা লাভে অনুতাপ, ধ্যান-প্রার্থনা, প্রায়শ্চিত্ত ও জীবন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন মানুষরূপে গড়ে উঠার সংকল্প গ্রহণ ও নিজেকে প্রস্তুত করি।

প্রকৃতপক্ষে, কাথলিক মণ্ডলিতে ভস্ম বুধবার পালন- এটা কোন আকষ্মিক ঘটনা নয়। এ কথা সত্য যে, মণ্ডলির ইতিহাসের একেবারে শুরুতেই খ্রিস্টীয় উপাসনায় ভস্মের কিছু কিছু ব্যবহার ছিল বলে আভাষ পাওয়া যায়। বাইবেলের গণনা পুস্তকের ১৯ অধ্যায়, যুডিথ পুস্তকের ৯ অধ্যায়ে এবং যোনা পুস্তকের ৩ অধ্যায়ে ভস্মের ব্যবহার উল্লেখ রয়েছে। কারণ ভস্ম ব্যবহারের মূলতঃ ২টি উদ্দেশ্য ছিল: পাপের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করা ও আত্মশুদ্ধি লাভ করা। বাইবেলের পুরাতন নিয়মের ঘটনাবলীর জের টেনে নতুন নিয়মেও ভস্ম ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে, যেমন: লুক ১০:১৩, মথি ১১:২১, হিব্রু ৯:১৩, ইত্যাদি।

এ ভস্মের ব্যবহার আনুষ্ঠানিকভাবে সপ্তম শতাব্দিতে রোম নগরে সর্বপ্রথম শুরু হয় এবং ভস্ম বুধবার পালন করার মধ্য দিয়ে তা আনুষ্ঠানিকভাবেই শুরু হয়। খ্রিস্টবিশ্বাসীগণ নিজেদের পাপের ক্ষমা লাভে ও অনুতাপের চিহ্নরূপে আশির্বাদিত ভস্ম কপালে মেখে প্রায়শ্চিত্তকালের সূচনা করেন। মাতা মণ্ডলিতে প্রথম কয়েক শতাব্দি ধরে প্রায়শ্চিত্তকালের সূচনা হয় প্রায়শ্চিকালের প্রথম রবিবার থেকে। তবে পঞ্চম শতাব্দির মাঝামাঝি এসে প্রায়শ্চিত্তকালকে আরো চারদিন বাড়িয়ে প্রথম রবিবারের আগের বুধবার থেকে আরম্ভ করা হয় এবং মাণ্ডলিক নির্দেশনায় এ বুধবারই ভস্ম বুধবাররূপে পরিগণিত হয়ে এখনও পর্যন্ত তার প্রচলন রয়েছে।

এ পরিবর্তনের মূল বিষয় হলো যে, প্রভু যিশু খ্রিস্টর মরু প্রান্তরে ৪০দিন উপবাসের স্মরণে এবং মাণ্ডলিক জীবনে খ্রিস্টবিশ্বাসীগণ ঐ অনুকরণে ৪০দিন ধ্যান-প্রার্থনা, উপবাস, দয়ার কাজ ও প্রায়শ্চিত্ত করে থাকে। কারণ রবিবারগুলোতে উপবাস করা হয় না বলে ঐ সময়টুকুতে অর্থাৎ ৪০দিনের রবিবারগুলোতে খ্রিস্টবিশ্বাসীগণ যাতে পুরোপুরি ৪০দিন উপবাস করার সুযোগ পেতে পারে সেজন্য প্রায়শ্চিত্তকালটি মোট ৪৬দিন ধার্য করা হয়েছে যা এখনও পালনীয়।

এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ ভস্মবুধবার দিন থেকে শুরু হচ্ছে খ্রিস্টীয় প্রায়শ্চিত্তকাল। এই উপবাসকালে বা প্রায়শ্চিত্তকালে আমাদের প্রতি ঈশ্বরের কি আহ্বান রয়েছে তা আমাদের চিন্তা ও ধ্যান করে দেখা দরকার। এই সময়টি ঈশ্বরই আমাদের দিয়েছেন- যেন আমরা আমাদের পাপ থেকে মন ফিরাতে পারি; যেন আমরা তাঁর কাছে ফিরে আসতে পারি। তাই, প্রায়শ্চিত্তকাল হলো মন পরিবর্তন করার সময়- ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভের একটি বিশেষ কাল। তাই, আমাদের উচিত হবে যেন আমরা আমাদের অন্তর গভীরে অতি সন্তর্পনে প্রবেশ করি এবং ঈশ্বরের সামনে উপস্থিত হওয়ার জন্য বা নতুন মানুষ হয়ে নিজেকে তাঁর কাছে উপস্থাপন করার জন্য প্রস্তুত করি। এটা সেই প্রস্তুতিরই সময়। এই সময় তাহলে আমরা কি করব তা ভেবে দেখতে হবে।

এই তপস্যাকালীন সময়ে খ্রিস্টমণ্ডলির ঐতিহ্য অনুসরণ করে আমরা তিনটি কাজ করি: প্রার্থনা, উপবাস, ভিক্ষাদান বা দয়ার কাজ। তাই, এই প্রায়শ্চিত্তকালে প্রভু যিশুর এই উক্তিটি আমাদের বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার- “তোমরা জেগে থাকো ও প্রার্থনা কর যেন পরীক্ষায় বা প্রলোভনে না পড়ো (মথি ২৬:৪১; লুক ২২:৪০)।”

সেই সাথে আমাদের এইটাও মনে রাখতে হবে যে, আমাদের প্রার্থনা যেন লোক দেখানোর বিষয় না হয় সেই কথাও যিশু আমাদের স্মরণ ক’রে দিয়েছেন: “যখন তোমরা প্রার্থনা করো, তখন ঘরের নিভৃতে গোপন স্থানে যাও আর প্রার্থনা করো (মথি ৬:৬)।”

উপবাসও যেন লোক দেখানো না হয়: “তোমরা যখন উপবাস করো, তখন তোমাদের মাথায় তেল মাখিয়ো ও চোখ মুখ ধুইয়ো (মথি ৬;১৭)।” তবে খ্রিস্টমণ্ডলি এখন খ্রিস্টভক্তদের ভস্মবুধবার ও পুণ্যশুক্রবার ব্যতীত আর পূর্বের ন্যায় উপবাস করতে বাধ্য করে না; তবে খ্রিস্টকে ভালবেসে এই দৈহিক সংযমটি পালন করতে খ্রিস্টভক্তদের উৎসাহ দিয়ে থাকে। শিশু, বয়োবৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তি ছাড়া আমরা যারা সক্ষম, আমরা চেষ্টা করবো যেন ৪০দিন ধরেই উপবাস করতে পারি।

আর এই উপবাসের সংযম পালন করে আমরা যা সঞ্চয় করবো তা থেকে আমরা যেন মাণ্ডলিক কাজে এবং আমাদের গরীব প্রতিবেশীদেরকে সাহায্য করতে পারি। তবে তা যেন আবার নিজের আত্মগরিমা বা অহঙ্কার বৃদ্ধির জন্য না হয়।

যিশু বলেছেন: “যখন তুমি ভিক্ষা দাও, তখন তোমার ডান হাত যা করছে তা যেন তোমার বাঁ হাত জানতে না পারে (মথি ৬:৩)।” এরই মধ্যদিয়ে আমরা আমাদের প্রতিবেশী ভাই-বোনদের যত্ন নেই এবং খ্রিস্টের দ্বারা সাধিত ভালোবাসার সংস্কৃতি গড়ে তুলি, যেন আমরা সকলে হয়ে উঠতে পারি সহযাত্রী, মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণধর্মী মণ্ডলি।

শুধু মানুষই নয় আমাদের যত্ন করতে হবে আমাদের পৃথিবীকে, গাছ-পালা ও জীব-জন্তুকে, প্রকৃতি ও পরিবেশসহ সব কিছুকেই। তা করতে হবে আমাদেরই স্বার্থে বা সমগ্র মানব জাতির মঙ্গলার্থে। ঈশ্বরের দান এই পৃথিবী, অর্থাৎ পোপ ফ্রান্সিসের কথায় যা নাকি আমাদের অভিন্ন বাসগৃহ, তার যত্ন করা মানে হলো আমাদের নিজেদের ও আমাদের ভাবি-প্রজন্মের ভবিষ্যতকে টেকসই করা। তাদের জন্য একটি সুন্দর ও টেকসই পৃথিবী রেখে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব।

আমরা সেই “দায়িত্ব প্রাপ্ত সেবক”, যাদের কাছে ঈশ্বর এই দায়িত্ব দিয়েছেন। বর্তমানে আমরা ধ্যান করছি পুণ্যপিতা পোপ মহোদয়ের ঘোষিত সিনোডাল চার্চ বা সহযাত্রী মণ্ডলি হওয়ার বিষয়টিকে নিয়ে। প্রিয় ভাই-বোনেরা, আসুন, আমরা এই প্রায়শ্চিত্তকালে আরো বেশি করে সহযাত্রী মণ্ডলি হয়ে উঠি মিলন, অংশগ্রহণ ও প্রেরণ কাজের দায়িত্ব পালন করে যেন আমরা খ্রিস্টের পুনরুত্থানে নবজীবন লাভ করতে পারি।

তাই আসুন, আমরা আমাদের প্রায়শ্চিত্তকালীন যাত্রায় আরো আত্ম সংযমী হই এবং উপবাস-ত্যাগস্বীকারের মধ্যদিয়ে নিজেদেরকে প্রস্তুত করে তুলি প্রভু যিশু খ্রিস্টের পুনরুত্থান পর্ব পালন করার জন্য।

আমি আমাদের ধর্মপ্রদেশের সকল উপকারী বন্ধু, দাতা সংস্থার সদস্য, সহযোগী ও পাঠক-পাঠিকাদের জানাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের প্রীতিপূর্ণ শুভেচ্ছা। শুভ হোক আমাদের পথ চলা। ঈশ্বর আপনাদের সকলকে আশির্বাদ করুন।

আপনাদের সেবায় খ্রিস্টেতে

বিশপ জের্ভাস রোজারিও, রাজশাহীর বিশপ